কক্সবাজারে খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা

শরীফ খিয়াম
2020.01.27
ঢাকা
200127_rohingya_ARSA_1000.jpg কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির। ৩১ আগস্ট ২০১৮।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের জঙ্গি গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

সাইফুল ওরফে পিটার নামের এক খ্রিস্টান রোহিঙ্গা ফোনে বেনারকে জানান, রবিবার দিবাগত রাতের ওই আক্রমণে ২৫টি খ্রিস্টান পরিবারের প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় হারিয়েছেন।

পুলিশ রোহিঙ্গাদের খ্রিস্টান পাড়ায় আক্রমণের ঘটনা নিশ্চিত করলেও, তাদের ভাষ্যমতে, এটি কোনো সন্ত্রাসী আক্রমণ নয়, বরং দুপক্ষের সাধারণ বিরোধের জেরে এই ঘটনা ঘটেছে।

আজ থেকে তেরো বছর আগে ২০০৭ সালে পরিবারের সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইনের মংডুর বলিবাজার থেকে পালিয়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের আশ্রয় নেওয়া সাইফুল সোমবার বেনারকে বলেন, “রোববার দিবাগত রাতে আরসার একটি সশস্ত্র দল আমাদের ঘরে ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়।”

তিনি বলেন, “গত বছরের মে মাসের ১০, ১১, ও ১৩ তারিখেও এই একই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল।”

“তারা চায় আমরা যেন এই রোহিঙ্গা শিবির ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। তাই ধারাবাহিকভাবে হামলা অব্যাহত রেখেছে” বলেন তিনি।

তবে পুলিশের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল মনসুরের দাবি, “আরসা বা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা সঠিক নয়। বিষয়টি শিবিরের একটি সাধারণ ঘটনা।”

প্রসঙ্গত, সরকার বাংলাদেশে আরসার উপস্থিতি বরাবরই অস্বীকার করে থাকে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে বিভিন্ন সময় আরসাকে দায়ী করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে ১০০ হিন্দু রোহিঙ্গাকেও হত্যা করেছে এই আরসা।

“রোববার তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে সাইফুল নামের এক খ্রিস্টান রোহিঙ্গা শুক্কুর নামের এক মুসলিম রোহিঙ্গার উপর হামলা করলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পরে শুক্কুরের স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে সাইফুল ও তাঁর স্বজনদের ওপর হামলা চালালে ওই পক্ষের চারজন আহত হন,” বলেন তিনি।

যে ব্লকের ঘটনা, সেখানকার রোহিঙ্গা নেতা আমিন মাঝি বেনারকে বলেন, “হেঁটে যাবার সময় ধরে এনে আবদুর শুক্কুর নামে এক রেহিঙ্গা মুসলিমকে মারধর করে খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা। এরপর মুসলিম রোহিঙ্গাদের লোকজন গিয়ে খ্রিস্টান পরিবারগুলোর ওপর হামলা চালায়।”

তবে সাইফুলের দাবি, আরসা-ই এই হামলা চালিয়েছে, তারা ঘরবাড়ি লুটপাট করছে, পুড়িয়েও দিয়েছে।

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে জালাল আহমদের ছেলে মংমসু ওরফে বজলু (৫০), এমদাদুল হকের ছেলে মোহামুদুল হক (৩৫), নুর সালামের ছেলে আলী জোহার (২২), মোহাম্মদ ইউনুছের মেয়ে রমিদা বেগমের (৪০) নাম জানা গেছে।

এছাড়া মাস্টার মোহাম্মদ তাহের নামের একজন পরিবারসহ নিখোঁজ রয়েছেন বলে বেনারকে জানান সাইফুল। তাঁর মতো তাঁরাও সবাই মংডুর বলিবাজারের আদি বাসিন্দা।

এর আগে ভারতে অবস্থানকারী ‘রোহিঙ্গা খ্রিস্টান অ্যাসমব্লি’র পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক ই-বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশ সময় রোববার দিবাগত রাত (সোমবার প্রথম প্রহর) ১২টা থেকে ১২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত কুতুপালং ক্যাম্পে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর আরসা আক্রমণ করেছিল, এতে ২৫টি খ্রিস্টান পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

এর মধ্যে অনেক নাবালক শিশু রয়েছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে রোহিঙ্গা খ্রিস্টানদের বাড়িঘর কেটে টুকরো টুকরো করে সমস্ত জিনিস ধ্বংস করে দিয়েছে।

আক্রমণে ১২ জন রোহিঙ্গা খ্রিস্টান মারাত্মকভাবে জখম হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয় ইমেইল বার্তায়।

এদিকে এই ঘটনাটির বিষয়ে খোঁজ নেবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার থেকে আসা হিন্দু রোহিঙ্গাদেরও আরসা বারবার হুমকি-ধামকি দিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। যে কারণে তারাই খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের সাথেও এমনটা ঘটাতে পারে।”

তিনি বলেন, “সম্প্রতি সংবাদপত্রে দেখেছিলাম, খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের সাথে বিদেশ থেকে এসে কারা যেন কথা বলেছে। তারা হয়ত তখন এমন কিছু বলেছে, যেটা আরসার মনঃপুত হয়নি।”

বিরোধ অনেক পুরানো

উখিয়ার কুতুপালং (পূর্ব) পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোবারক হোসেন জানান, ওই শিবিরে দীর্ঘ দিন থেকেই মুসলিম ও খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। রাতে সংর্ঘষের খবর পেয়ে তাঁরা সেখানে পৌঁছে দেখেন খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের কিছু বাড়ি ঘর ভাংচুর করা হয়েছে।

“পুলিশ সেখানে পৌঁছালে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়,” বেনারকে বলেন তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তা মোবারক বলেন, “মুসলিমদের দাবি, ওই রোহিঙ্গারা মুসলিম হয়েও খ্রিস্টান ধর্ম পালন করছে। অন্যপক্ষের দাবি, তারা খ্রিস্টান। এ নিয়ে যে মতপার্থক্য ছিল, সেটিকে কেন্দ্র করেই এই সংর্ঘষের ঘটনা ঘটেছে।”

“এর আগেও ক্যাম্পের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ছোটখাট সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে,” উল্লেখ করে মুসলিম ধর্মালম্বী রোহিঙ্গা আমিন মাঝি বলেন, “তারা (খ্রিস্টানরা) সবাই বাংলাদেশে আসার পরে ধর্ম বদলিয়েছে।”

তবে সাইফুলের দাবি, তাঁদের অনেকেই মিয়ানমারে থাকাকালীনই মুসলিম ধর্ম ত্যাগ করেছেন।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৪৪৪টি হিন্দু পরিবার রয়েছে। এ ছাড়া খ্রিস্টান পরিবার আছে ২৫টি, সদস‍্য প্রায় দুইশ। এর বাইরে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে রয়েছেন ১১ লাখের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী।

কক্সবাজারের উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্যে একজন হিন্দু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁকে মুসলিম রোহিঙ্গারা খুন করেছে বলে অভিযোগ ওঠে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান ও ঢাকা থেকে সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।