খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা: একটি পরিবার নিখোঁজের তদন্ত শুরু

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2020.01.30
ঢাকা ও কক্সবাজার
200130_Missing_Christian_rohingya_1000.jpg উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের একাংশ। ২১ আগস্ট ২০১৮।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার তিন দিন পর নিখোঁজ এক পরিবারের খোঁজে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে পুলিশ। রোববার দিবাগত রাতে কুতুপালং শিবিরে খ্রিস্টান পাড়ায় আক্রমণের পর থেকে হামলাকারীরা এক খ্রিস্টান পরিবারকে ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ আসে।

পুলিশ তখন বলেছিল, ওই পরিবারের নিখোঁজ থাকার ব্যাপারে তারা কিছু জানে না।

গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম প্রহরের ওই হামলার ঘটনায় পরস্পরকে অভিযুক্ত করে বুধবার রাতে খ্রিস্টান ও মুসলমান, দুই পক্ষের রোহিঙ্গারাই উখিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলা দায়েরের পর কতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক সমীর চন্দ্র সরকার বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা তাঁদের একটি পরিবার নিখোঁজ থাকার কথা বলেছেন। এই বিষয়টিও আমরা খতিয়ে দেখছি।”

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল মনসুর বেনারকে জানান, রোববার দিবাগত রাতের হামলার দায়ে খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা ৫৯ মুসলিম রোহিঙ্গাকে দায়ী করে মামলা করেছেন। অন্যদিকে মুসলিম রোহিঙ্গা শুক্কুর আলীকে আক্রমণের দায়ে মামলা করা হয়েছে ১৩ খ্রিস্টান রোহিঙ্গাকে দায়ী করে।

মুসলিমদের পক্ষে শুক্কুরের মা লাইলা বেগম (৪৫) এবং খ্রিস্টানদের পক্ষে সি থুয়ে (৩৮) মামলা দায়ের করেছেন বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পের খ্রিস্টান পাড়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় লাইলা বেগমের ছেলে আবদুর শুক্কুরকে (২৫) সন্ত্রাসী আখ্যা সাইফুল ইসলাম ওরফে পিটার নামের এক খ্রিস্টান যুবকের নেতৃত্ব মারধর করা হয়। এরই জেরে রাত ১২টার পর খ্রিস্টান পাড়ায় হামলা চালায় ক্ষিপ্ত মুসলিম রোহিঙ্গারা।

খ্রিস্টান রোহিঙ্গা সাইফুল ইসলাম পিটার বেনারকে বলেছেন, আক্রমণকারীরা জঙ্গি গোষ্ঠী আরসার সদস্য। আর শুক্কুর আক্রমণকারীদের একজন। তাঁকে আক্রমণের সময় আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয় বলে জানান তিনি।

তবে “বাংলাদেশে আরসা বলে কিছু নেই,” মন্তব্য করে ওসি আবুল মনসুর বলেন, “দুই মামলার অভিযুক্তদেরই গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।”

“সাইফুল নামের এক খ্রিস্টান রোহিঙ্গা শুক্কুর নামের এক মুসলিম রোহিঙ্গার ওপর হামলা করলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। পরে শুক্কুরের স্বজনেরা ক্ষুব্ধ হয়ে সাইফুল ও তাঁর স্বজনদের ওপর হামলা চালালে ওই পক্ষের চারজন আহত হন,” রোববার রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন ওসি মনসুর।

এদিকে আক্রমণের পর সোমবার সকালে একটি খ্রিস্টান পরিবারকে আরসা সন্ত্রাসীরা বেঁধে নিয়ে গেছে বলে বেনারকে জানান পিটার।

বুধবার বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) কাছে ভারতে অবস্থানকারী ‘রোহিঙ্গা খ্রিস্টান অ্যাসেমব্লি’র পক্ষ থেকে পাঠানো এক ই-বার্তায়ও একই অভিযোগ করে বলা হয়, নিখোঁজ পরিবারের চার সদস্যের নাম তাহের, খুরশিদা, মিজান এবং মরিয়ম।

অপহরণকারীদের মুখ ঢাকা ছিল উল্লেখ করে এতে বলা হয়, তাহের খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের নেতা ছিলেন।

তাদের দাবি, খ্রিস্টানদের ওপর ওই আক্রমণ করেছিল রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।

ওই আক্রমণে ২৫টি খ্রিস্টান পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানানো হয় ইমেইল বার্তায়।

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

খ্রিস্টানরা জানান, মুসলিম রোহিঙ্গারা খ্রিস্টানদের ১৭টি বাড়িঘর ছাড়াও একটি প্রার্থনালয়ে আক্রমণ চালায়। তাঁদের বিরুদ্ধে মারধর এবং লুটপাটের অভিযোগ করেছেন খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা।

খ্রিস্টানদের পক্ষের বাদী সি থুয়ে বেনারকে বলেন, “মামলায় কুতুপালং ক্যাম্পের কলিম নামের এক মুসলিম সন্ত্রাসীকে প্রধান আসামি করে ৫৯ জনের বিরুদ্ধে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “সবাইকে দ্রুত গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে বলে পুলিশ আমাদের জানিয়েছে।”

“খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের আতঙ্ক তবুও কাটছেই না। আমরা এখনো ভয়ের মধ্যে আছি। আমাদের লোকজনকে ফোন করে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে,” বলেন সি থুয়ে।

এমন হুমকি পাওয়া খ্রিস্টান রোহিঙ্গা নারী রশিদা বেগম বেনারকে বলেন, “এক মুসলিম সন্ত্রাসী আমাকে ফোন করে অনেক গালাগালি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।”

এদিকে মুসলিমদের পক্ষে মামলার বাদী লাইলা বেগম বেনারকে বলেন, “আমার ছেলে (শুক্কুর) খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল না। আমি তাঁর ওপর হামলার বিচার চাই। জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাই।”

শুক্কুরের বোন নুর ফাতেমা বেনারকে বলেন, “খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা কোনো কারণ ছাড়াই আমার ভাইকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে মারধর করেছে। এখন তার নামে তারা অনর্থক মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছে।”

ভয়ে আছেন খ্রিস্টান রোহিঙ্গারা

হামলার পর ১৭টি খ্রিস্টান পরিবারকে সোমবার সকালে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ট্রানজিট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।

ট্রানজিট সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া নুরু ফকির জানান, “বুধবার আরও চারটি খ্রিস্টান পরিবার এই সেন্টারে এসে আশ্রয় নিয়েছে।”

তিনি বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে যেসব খ্রিস্টান রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে তাঁরা ভয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন।”

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের উপ-সচিব মো. খলিলুর রহমান খান বেনারকে বলেন, “আগামী রোববার বিকেলে অনুষ্ঠিতব্য এক বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে।”

তিনি জানান, ওই বৈঠকে খ্রিস্টান রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে পারে।

বুধবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকা অফিসের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “ইউএনএইচসিআর এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন আছে। শিবিরে থাকা সব শরণার্থী যাতে শান্তিতে ও নিরাপদে এক সাথে থাকতে সক্ষম হয় তা নিশ্চিত করতে আমরা সব সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।”

এদিকে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করেই রোহিঙ্গা খ্রিস্টানদের ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বেনারকে জানান সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মাহবুব আলম তালুকদার।

প্রসঙ্গত, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৪৪৪টি হিন্দু পরিবার রয়েছে। এ ছাড়া খ্রিস্টান পরিবার আছে ২৫টি, সদস‍্য প্রায় দুইশ। এর বাইরে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে রয়েছেন ১১ লাখের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী।

কক্সবাজারের উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্যে একজন হিন্দু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁকে মুসলিম রোহিঙ্গারা খুন করেছে বলে অভিযোগ ওঠে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।