রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নাগরিকত্ব দেওয়ার পক্ষে আনান কমিশন

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2017.01.31
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালি বস্তির অস্থায়ী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারী ও শিশু কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালি বস্তির অস্থায়ী ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। জানুয়ারি ২৯, ২০১৭।
স্টার মেইল

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং ধর্মীয় মর্যাদা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ সফররত আনান কমিশনের প্রতিনিধিদল।

মঙ্গলবার ঢাকার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান তাঁরা।

এ সময় প্রতিনিধিদলের প্রধান লেবাননের নাগরিক ঘাশান সালামেন বলেন, “রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়াই এ সমস্যা সমাধানের উত্তম চাবিকাঠি।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সালামেন বলেন, “শুধু ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের ফলেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে, তা নয়। এর সঙ্গে তাঁদের নাগরিকত্ব, অধিকার ও জীবিকার প্রশ্নগুলোও জড়িয়ে রয়েছে। তাই তাঁদের নাগরিকত্বের সমস্যা সমাধান করাটাই মুখ্য বিষয়।”

গত বছরের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নি‌র্যাতনে উদ্ভূত পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশে সফর করছে এই প্রতিনিধি দল। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে রাখাইন প্রদেশের সংকট নিরসনে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য এই কমিটি গঠন করেন। রাখাইনের সকল নাগরিকের নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বিষয়ে সুপারিশ করবে এই কমিশন।

গত শনিবার ঢাকায় আসার পর প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শন করে সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে। কোন পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন, তা জানার চেষ্টা করেন দলের সদস্যরা।

আনান কমিশনের প্রতিনিধিদলের অন্য দুই সদস্য হলেন মিয়ানমারের নাগরিক উইন ম্রা ও আই লুইন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বুধবার দলটি বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।

এই কমিশনের কমর্কাণ্ড নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকেরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “কোনো কমিশনের সুপারিশ রাতারাতি বাস্তবায়ন হয় না। তবে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ হলে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

এ প্রসঙ্গে অভিবাসন-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) অধ্যাপক সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “কিছুদিন আগেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যাকে স্বীকার করত না। দীর্ঘদিন পরে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি কমিশন গঠন করেছে। এর অর্থ সমস্যাটি তারা স্বীকার করতে শুরু করেছে। আশা করছি, তাদের সুপারিশের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দিকে যাবে।”

চাপ অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র

এদিকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান একমাত্র মিয়ানমারের কাছে রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, এ বিষয়ে দেশটির ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার কক্সবাজারের টেকনাফে দুটি রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

গত অক্টোবরের পর এটাই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রথম রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে তিনি রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করছেন জানিয়ে বার্নিকাট স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এই চাপ অব্যাহত থাকবে।”

কক্সবাজার থেকে স্থানান্তর হবে রোহিঙ্গারা

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ছড়িয়ে পড়া রোধে তাদের একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখার ব্যবস্থা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের নাগরিকদের নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার ঠ্যাঙ্গার চরে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক বদর মুনীর চৌধুরি বেনারকে বলেন, “বেশ আগে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে স্থানান্তরের জন্য আমাদের কাছে জায়গা চাওয়া হয়। আমরা ঠেঙ্গার চরে পাঁচ শ একর জায়গার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম।”

জেলা প্রশাসক বলেন, “আট–দশ বছর আগে চরটি জেগে ওঠে। এটি আরও হয়ত জাগবে। এখন কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তার সর্বশেষ অগ্রগতি আমার জানা নেই।”

তবে ওই চর এখনো মানুষের বসবাসযোগ্য হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

হাতিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন বেনারকে বলেন, “ঠেঙ্গার চর নতুন জেগে উঠেছে। সেখানে এখনো নিয়মিত জোয়ার ভাটা হয়। কোনোভাবেই সেটি বসবাস যোগ্য নয়।”

এ প্রসঙ্গে সি আর আবরার বলেন, এ ধরনের স্থানান্তর কতটুকু যুক্তিসংগত, আদৌ বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা সেটা দেখা দরকার। সেখানে লোকজন যেতে আগ্রহী কিনা সেটাও দেখতে হবে।

তিনি বলেন, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করে। নির্জন চরাঞ্চলে গিয়ে তারা কীভাবে আয় করবে? সরকারের কোনো পরিকল্পনা থাকলে তা পরিষ্কার করে জানানো উচিত।

নতুন আসা রোহিঙ্গা ৬৭ হাজার

গত অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে করেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান তিনি।

তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশন পরিচালিত দুটি রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে ৩৩ হাজারের বেশি নিবন্ধিত শরণার্থী এবং তিন লাখের বেশি অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক বিভিন্ন অস্থায়ী শিবিরে অবস্থান করছে। এ ছাড়া সম্প্রতি আরও ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে করেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।