শুধুই ধর্মশিক্ষা পেয়ে বড়ো হচ্ছে অধিকাংশ রোহিঙ্গা শিশু
2017.02.02
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিশুরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ পেলেও বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে লাখ লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিশু। মহল্লাভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষাই কেবল তাঁদের সম্বল।
বিশ্লেষকেদের মতে, প্রচলিত শিক্ষার অভাব অসহায় এই জনগোষ্ঠীকে আরও পিছিয়ে দিচ্ছে। কেবল ধর্মীয় শিক্ষা রোহিঙ্গা শিশুদের অনেককেই মৌলবাদের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে।
তা ছাড়া যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় এখন যেমন বাংলাদেশের জন্য, ভবিষ্যতে ফিরে গিয়ে মিয়ানমারের জন্যও তারা বোঝা হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ঘুরে পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পেয়েছে বেনারনিউজ।
সরকারি হিসেব বলছে, গত কয়েক দশকে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে মাত্র ৩৫ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ছেলেমেয়েরা মূল ধারার শিক্ষা নিতে পারে। সেটাও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত।
অন্যদিকে অনিবন্ধিতদের সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি, যাঁরা শুধু অনানুষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষা পায়। গত বছর অক্টোবরের পর থেকে নতুন করে আরও ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। ফলে বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা শিশু প্রতিদিন অনিশ্চিত জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
গত ১৪-১৮ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য মূলত শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় মহল্লায় মহল্লায় একটি করে মক্তব গড়ে তুলেছেন। সেখানে শুধু মাত্র ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়।
লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি ব্লকের মক্তবের মৌলভি তৈয়ুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “এখানে প্রায় সাড়ে চার’শ শিশুকে শুধু আরবি পড়ানো হয়। প্রচলিত অন্য কোন শিক্ষা তারা পায় না। ফলে আধুনিক যুগ থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে এখানকার শিশুরা।”
লেদা ক্যাম্পে এ ধরনের নয়টি মক্তব রয়েছে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের খরচেই মক্তবগুলোতে কয়েক হাজার শিশুকে আরবি শিক্ষা দেওয়া হয়।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা (মাঝি) মো. তৈয়ব বেনারকে বলেন, “এখানকার বাচ্চারা সকালে কিংবা বিকেলে শুধু আরবি পড়ে। বাকি সময় ওরা ভিক্ষা করেই কাটায়।”
টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আহমেদ কবীর বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারেও সরকারিভাবে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখার ব্যবস্থা নেই। টাকা দিয়েই সন্তানদের পড়ালেখা করাতে হতো। এখানে সে সুযোগও নেই। এখানকার স্কুলে রোহিঙ্গা ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হতে পারে না।”
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া কিশোর (১৬) মো. সাদেক বেনারকে বলেন, “আমি নবম শ্রেণিতে পড়তাম। এখানে এসে আর পড়তে পারিনি। আবার এখানকার পড়ালেখাও আমি জানি না, কাজও পাচ্ছি না। আবার ভিক্ষা করতেও লজ্জা পাই।”
একই ক্যাম্পের শিশু মোছা. মুন্নী (৮) জানায়, মিয়ানমারে স্কুলে গেলেও এখানে সে খেলাধুলা আর ভিক্ষা করে সময় কাটায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা বেনারকে জানান, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কোনো ধরনের সেবা দেওয়ার অনুমতি তাঁদের নেই। তবে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের মিয়ানমারের ভাষাও শেখানো হয়।
তবে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা কোনো কোনো রোহিঙ্গা পরিচয় গোপন করে স্থানীয় স্কুলগুলোতে নিজ সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন। লেদা ক্যাম্পের এ ব্লকে একটি ঘরে এমনই এক ছাত্রকে পাওয়া গেল। স্থানীয় নুরানি মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ফারুক মনোযোগ দিয়ে বাংলা হাতের লেখা লিখছিল।
তার মা (পরিচয় গোপন রাখা হলো) বেনারকে বলেন, “ছোট থেকেই ওর পড়ালেখায় খুব আগ্রহ। একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছি। পড়ালেখায় ভালো। ১৮ বছর ধরে বাস করছি এখানে। এটুকু অধিকার তো পেতেই পারি।”
দুই দেশেরই বোঝা
এসব রোহিঙ্গা শিশুরা কবে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে পারবে সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। তাই অশিক্ষিত হয়ে বেড়া ওঠা শিশুরা বাংলাদেশের জন্যই বোঝা হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “শুধু ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হলে অনেকেই মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাঁর মতে, যতটা সময় তারা বাংলাদেশে থাকুক, এসব শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। রাষ্ট্রের তরফ থেকে না পারলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।”
এ বিষয়ে অভিবাসন-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) অধ্যাপক সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “অশিক্ষিত হয়ে গড়ে ওঠা এসব শিশু মিয়ানমারে যাওয়ার সুযোগ পেলেও সেখানে নিজেদের দক্ষ, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে না। ফলে অনিয়মিত শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশে চলে আসার শঙ্কা থেকেই যাবে। এ বিষয়টি বিবেচনা করেই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে তাদের কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।”
তবে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে ভাষাগত পার্থক্যকে বাধা মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
বেনারকে তিনি বলেন, “শিক্ষার সঙ্গে ভাষার বিষয় জড়িত। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে এসব শিশুর জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করাটা কঠিন। কারণ, তারা সাময়িক সময়ের জন্য এসেছে। তবে তাদের ন্যূনতম সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য যত দ্রুত সম্ভব তাদের দেশে ফেরত পাঠানো। অন্য কোনো বিষয়ে আপাতত ভাবতে চাইছে না সরকার। এ কারণে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতিও দেবে না বাংলাদেশ।”