মিয়ানমার নিরাপত্তা রক্ষীরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে: জাতিসংঘ প্রতিবেদন
2017.02.03
মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষীরা দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। শহরটিতে তারা নির্বিচারে গণধর্ষণ, শিশু হত্যা, নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছে। গুম করেছে বেশকিছু মানুষকে।
শুক্রবার প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সহিংসতার শিকার ওই রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদন তৈরি করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার তদন্তকারী একটি দল ২০৪ জন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকার নেয়। এদের প্রায় সবাই হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রায় অর্ধেক নিজ পরিবারের কেউ না কেউ হত্যার শিকার বা নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া ১০১ জন নারীর অর্ধেকের বেশি ধর্ষণ বা বিভিন্নভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
এর আগে তিনভাগের এক ভাগ রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে বেনার নিউজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বেনারের পক্ষ থেকে ৫৪ জন নতুন শরণার্থী রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। তাদের মধ্যে ১৭ জনই দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধর্ষিত হওয়ার কথা জানান।
সম্প্রতি লেবাননের নাগরিক ঘাশান সালামেনের নেতৃত্বে কফি আনান কমিশনের তিন সদস্য বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ঘুরেও নারীদের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা জানতে পারেন।
এদিকে গতকাল প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের একটি শিশু এবং ছয় বছরের একটি শিশুসহ অন্য শিশুরা নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছে তা লোমহর্ষক।
একজন মা বলেছেন, তাঁকে ধর্ষণের সময় তার পাঁচ বছরের কন্যা যখন প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিল তখন এক ব্যক্তি একটি লম্বা ছুরি দিয়ে তাকে গলা কেটে হত্যা করে। আরেক মাকে পাঁচজন নিরাপত্তা রক্ষী মিলে গণধর্ষণের সময় তার আট মাস বয়সী বাচ্চা পেটে মারা যায়।
প্রতিবেদনে বর্ণিত হিংস্রতাকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রাদ আল হুসেইন (Zeid Ra’ad Al Hussein) বলেন, রোহিঙ্গা শিশুরা যে নৃশংসতার শিকার হয়েছে তা মর্মান্তিক। মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য কেঁদে ওঠা শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই সময়টাতে নিরাপত্তা রক্ষীরা শিশুটির মাকে গণধর্ষণ করছিলেন। ধর্ষিত হতে হতেই তাকে নিজ সন্তানের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করতে হয়।
“মিয়ানমারের নেতৃত্বকে এ ধরনের সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। অভিযোগের ভয়াবহতা এবং মাত্রা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে,” বলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রাদ আল হুসেইন।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। যে সকল রোহিঙ্গা নারীরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে পেরেছে, তাদের অধিকাংশ চরম বর্বরতার শিকার হয়েছে, অনেকেই ধর্ষিত হয়েছে।”
বাংলাদেশের ওই মানবাধিকার কর্মীর মতে, এটা শুধু সংখ্যা দিয়ে নির্ণয়ের ব্যাপার নয়। মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করে এসব মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এই নারকীয় নির্যাতনের বিচারের দাবি তোলা উচিত।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যটি সবচেয়ে বেশি বর্বরতার শিকার হয়েছে। ওই এলাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তাদের ঢোকার অনুমতি দিতে বারবার অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার। এরপর হাইকমিশনার জাইদ মানবাধিকার কর্মীদের বাংলাদেশের মিয়ানমার সীমান্তে পাঠান।
প্রতিবেদনে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং উচ্ছৃঙ্খল জনসাধারণের দ্বারা রোহিঙ্গাদের বাড়ি, স্কুল, বাজার, দোকান, মসজিদ এবং মাদ্রাসা পুড়িয়ে দেওয়ার সাক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা খাবার এবং খাবারের উৎস যেমন শস্য খেত এবং গৃহপালিত পশুপাখি ধ্বংসের বর্ণনা দিয়েছেন।
বহুসংখ্যক ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া সাক্ষ্য নিশ্চিত করে যে, সেনাবাহিনী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘরের মধ্যে পরিবারের লোকজনকে রেখেই আগুন ধরিয়ে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগুনে পুড়তে থাকা ঘরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া আশ্রয় নিতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বহুসংখ্যক মানুষ গুলিতে নিহত হয়েছেন। যারা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন তাদের জরুরি চিকিৎসা সেবা নেওয়ার সুযোগও নেই।
অনেকে বলেছেন, তাদের মারধর, নির্যাতন ও ধর্ষণের সময় ‘তোরা বাংলাদেশি, তোরা চলে যা, অথবা ‘তোদের আল্লাহ তোদের জন্য কী করতে পারে? দেখ আমরা কী করতে পারি’—এসব কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ওপর যে ধরনের নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের মানবিক কর্মসূচির সমন্বয় বিষয়ক কার্যালয়ের (ওসিএইচআর) এর হিসাব মতে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ৬৬ হাজার পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখনো ২৩ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছেন।
মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া
রোহিঙ্গা নির্যাাতন বিষয়ে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার আগে মিয়ানমার সরকার বরাবরই রোহিঙ্গাদের উপর কোনো ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে আসছিল। তবে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবার পর শুক্রবার তারা এক সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
রয়টার্স জানাচ্ছে, ইয়াঙ্গুনে প্রতিবেদনের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জু থ্য বলেন, “এই অভিযোগুলো খুবই গুরুতর। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা ভাইস প্রেসিডেন্ট উ মিন্ট সুর নেতৃত্বে পরিচালিত তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে শিঘ্রই অভিযোগগুলোর বিষয়ে তদন্ত করব।”
তিনি আরো যোগ করেন “যেসব ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া যাবে, সেসব ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি