রোহিঙ্গা গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজতে আইসিসি’র তদন্ত শুরু

জেসমিন পাপড়ি
2020.02.04
ঢাকা
200204_press_conference-ICC_1000.JPG ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন বাংলাদেশ সফররত আইসিসি প্রতিনিধিদলের প্রধান ফাসিকো মোচোচোকো। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
[বেনারনিউজ]

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।

বাংলাদেশ সফররত আইসিসি প্রতিনিধিদলের প্রধান ফাসিকো মোচোচোকো মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান। তিনি জানান, মূলত রোহিঙ্গা ‘গণহত্যায়’ কারা জড়িত ছিল তা খুঁজে বের করতে তদন্ত চালানো হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আইসিসি’র কর্মকর্তা নিকোলা ফ্লেচারও উপস্থিত ছিলেন। আইসিসি প্রতিনিধিরা গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধ আর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক এই দুই আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার বিচারে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

ফাসিকো মোচোচোকো জানান, এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই আইসিসির তদন্ত শুরু হয়েছে। আইসিসি প্রতিনিধিদলের এই সফরও তদন্তের একটা অংশ।

রোহিঙ্গা গণহত্যায় দায়ী করে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে) মিয়ানমারের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন কিছু আদেশ দেওয়ার দু সপ্তাহের ভেতর দেশটির বিরুদ্ধে আইসিসির তদন্ত শুরু হলো। এর ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধ আর গণহত্যার দায়ে বিশ্বে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক দুই আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার দায়ে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

আইসিজের দেওয়া আদেশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে আইসিসি। তারা বলছে, আইসিজেতে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলেও দেশটির অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করবে আইসিসি।

ফাসিকো মোচোচোকো বলেন, “আমাদের প্রশ্ন হলো—কে অপরাধ করেছে, কে অপরাধে সহায়তা করেছে? অপরাধ, নির্যাতন, ধর্ষণ কোনো ব্যক্তি করে। আইসিসির প্রশ্ন—ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা কারা?”

“আমরা প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করছি যাতে নির্দিষ্টভাবে বলতে পারি কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা অপরাধ করেছেন,” বলেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে মোচোচোকো জানান, তাঁরা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) দ্বারা সংগঠিত অপরাধও পর্যালোচনা করবেন।

“তবে ওইসব অপরাধের মাত্রা রোম সংবিধিমতে যথেষ্ট কি না, আদালতের এখতিয়ারভুক্ত কি না এবং আইসিসির কোনো অঞ্চলকে বিচারের আওতায় আনার শর্তগুলো পূরণ করে কি না- সেই প্রশ্নগুলোরও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে,” বলেন মোচোচোকো।

আইসিজে ও আইসিসির পাশাপাশি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়া (আইআইএমএম)। গত নভেম্বরের শেষে তাদের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা ও কক্সবাজার সফর করে। তদন্তের মাধ্যমে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জাতীয়, আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক আদালতে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করবে আইআইএমএম।

প্রসঙ্গত, গত নভেম্বর প্রসিকিউটর ফেতু বেনসুদার আবেদনের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের অনুমোদন দেয় আইসিসি।

‘গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’

একের পর এক এসব আইনি উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মূলনীতি অনুযায়ী, আইসিসি দেখবে মিয়ানমারে যে গণহত্যা হয়েছে সেখানে কোন ব্যক্তি বা কারা কারা জড়িত। এটা করা অত্যন্ত জরুরি।”

“কারণ এই আন্তর্জাতিক অপরাধ যারা করেছে সেই ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা না গেলে, তাদের শাস্তি দিতে না পারলে, বিচারের মূল্য থাকে না। বিচার অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। সেদিক থেকে চিন্তা করলে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ,” বলেন তিনি।

“এটা আন্তর্জাতিক আইনের জন্য, ন্যায় বিচারের জন্য, রোহিঙ্গাদের স্বার্থে খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ,” বলেন ড. মিজান।

“এখতিয়ার না থাকায় আইসিজে দোষীকে খুঁজে বের করা বা শনাক্ত করেনি। তবে আইসিজের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশকে আইসিসি অবশ্যই একটা যুক্তি এবং অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে,” মনে করেন এই আইনজ্ঞ।

এসব বিচার প্রক্রিয়া রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াবে বলেও মত দেন ড. মিজান।

আইসিসি প্রতিনিধিদলের প্রধান জানান, গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষমতা রাখে আইসিসি।

তিনি বলেন, আইসিসির বিচারকের অনুমতি নিয়ে প্রসিকিউশন টিমের এই তদন্তের উদ্দেশ্যে হচ্ছে রোহিঙ্গা গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালতে যথেষ্ট প্রমাণ ও দলিল উপস্থাপন করা।

“তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের গোপনীয়তা যথাযথভাবে রক্ষা করা হবে এবং তা কোনোভাবেই প্রকাশ করা হবে না। তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের পর আদালতে মূল বিচার কার্যক্রম শুরুর আবেদন করা হবে,” বলেন ফাকিসো মোচোচোকো।

সহায়তা করছে না মিয়ানমার

আইসিসি প্রসিকিউশন কার্যালয়ের পরিচালক ফাকিসো মোকোচোকো বলেন, এই তদন্তে বাংলাদেশ সার্বিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তবে মিয়ানমার কোনো সহায়তা করছে না। ফলে প্রমাণ ও দলিল সংগ্রহে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমার রোম সংবিধিতে (স্টাটিউট) স্বাক্ষরকারী দেশ না হওয়ায় তারা তদন্তে সহায়তা করতে বাধ্য নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে ফাকিসো মোকোচোকো জানান, আইসিসি রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার শেষ করে জড়িত অপরাধীদের দণ্ডিত করলে সেটা মিয়ানমার নাও মানতে পারে। কিন্তু আইসিসির ১২৩টি সদস্য রাষ্ট্রের ওপর এই রায় কার্যকর করার বাধ্যবাধকতা থাকবে।

“এর ফলে রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে আইসিসির রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো মিয়ানমার নাগরিক আইসিসির সদস্য রাষ্ট্রে গেলে, ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের বাধ্যবাধকতা থাকবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ওপর,” বলেন তিনি।

আইসিসির দণ্ডের ধরন সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে ফাকিসো জানান, আইসিসি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনসহ যে কোনো মেয়াদে কারাদণ্ডের শাস্তি দিতে পারে।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ফাকিসো বলেন, “মিয়ানমার রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী দেশ না হলেও সে দেশে সংঘটিত গণহত্যার তদন্ত এবং বিচারে কোনো বাধা নেই। তারা সহায়তা না করলেও তদন্ত চলবে এবং সময়সাপেক্ষ হলেও আইসিসিতে এর শুরু হবে।”

এ বিষয়ে ড. মিজানুর রহমান বলছিলেন, “যখনই আন্তর্জাতিক অপরাধ হয় তখন কে রোম স্টাটিউট স্বাক্ষর করেছে বা করেনি সেটা অবান্তর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, গণহত্যা আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। আর এ ধরনের অপরাধ যখন হয় তখন তার ওপর সর্বজনীন এখতিয়ার কার্যকর হয়।”

“এখানে রাষ্ট্র নয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক আইনের এখতিয়ারভুক্ত হয়ে গেল। তখন যেকোনো রাষ্ট্র ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটাই আন্তর্জাতিক আইনের মূল কথা,” বলেন তিনি।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে না

আইসিসি তদন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে না উল্লেখ করে ফাকিসো বলেন, “বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত গেলেও তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া চলবে।”

রোহিঙ্গা নেতা সাঈদ আলম বেনারকে বলেন, “যারা রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতা চালিয়ে আসছে, সেইসব ব্যক্তিদের বিচার করা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে আইসিসি তদন্ত শুরু করেছে, এটা দারুণ খবর। রোহিঙ্গারা আইসিসি তদন্ত দলকে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।”

উল্লেখ্য, সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাদের নৃশংস নির্যাতন থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে নতুন পুরোনো মিলিয়ে সাড়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে বসবাস করছে।

দুই দফায় তারিখ ধার্য করার পরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। কারণ, রাখাইনে এখনো ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গারাও জানিয়েছেন নাগরিকত্ব না দিলে তাঁরা মিয়ানমারে ফিরবেন না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।