চার দিনে মালয়েশিয়াগামী প্রায় একশো রোহিঙ্গা আটক

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2019.02.11
কক্সবাজার ও ঢাকা
190211_Human_Trafficking_1000.jpg একমাত্র সন্তানকে নিয়ে মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছিলেন এই রোহিঙ্গা নারী। ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

নারী ও শিশুসহ প্রায় একশো রোহিঙ্গার অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়া আটকে দিয়েছে বিজিবি ও পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার থেকে রবিবারের মধ্যে টেকনাফ ও উখিয়ার উপকূলীয় এলাকায় ৯২ জন রোহিঙ্গা ধরা পড়ে। আটক হয়েছে চার বাংলাদেশি পাচারকারী।

“উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা মানবপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিল,” বেনারকে বলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টেকনাফ-২ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আছাদুজ্জামান চৌধুরী।

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব-৭) টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহাতাব বেনারকে বলেন, “স্থানীয় মানবপাচারকারী চক্রটি পুনরায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।” পুলিশের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়েরের দাবি, “পাচারকারীদের মূল লক্ষ্য এবার রোহিঙ্গা শিবিরগুলো।”

সম্প্রতি পাচারকারী চক্রটি প্রচার করে যে, রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা একটি বড় জাহাজের ব্যবস্থা করেছে। জাহাজটি গভীর সাগরে অপেক্ষমাণ রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই জাহাজের উদ্দেশ্যে রওনা করে ধরা পড়তে থাকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু শরণার্থীরা।

সর্বশেষ রবিবার রাতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের উত্তর লম্বী উপকূল এলাকা থেকে ২২ রোহিঙ্গা ধরা পড়ে, যার মধ্যে ১১ শিশু ছাড়াও ছিল ১০ নারী। এর আগে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার টেকনাফ-উখিয়ায় আটক হওয়া ৭০ রোহিঙ্গার মধ্যেও ৩৮ জনই নারী।

বিগত বছরে র‍্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু যে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করেছিল, তাদেরও সিংহভাগই ছিল নারী, জানান লেফট্যানেন্ট শাহেদ।

এদিকে লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুল মোতালেব বেনারকে বলেন, “স্থানীয় (বাংলাদেশি) পাচারকারীদের সহযোগী রোহিঙ্গা দালালেরাও ফের সক্রিয় হয়েছে।” এ ছাড়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক হওয়া পাচারকারীরা তাদের চক্রের যে দালালদের নাম প্রকাশ করেছে, তাদের অধিকাংশই উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা।

“এ কারণে শিবিরগুলোয় পুলিশি তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। যেসব রোহিঙ্গা দালাল রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে,” বলেন ওসি খায়ের। এছাড়া পাচার ঠেকাতে র‍্যাবের টহলও জোরদার করা হয়েছে বলে জানান লেফট্যানেন্ট শাহেদ।

গ্রেপ্তার হওয়া চার পাচারকারী হলো মোহাম্মদ মামুন (২২) ও আবদুল কাদের (৩৩), মহিবুল্লাহ (২০) ও মোহাম্মদ হুমায়ুন (১৮)।

বিয়ের প্রলোভনে যাচ্ছে নারীরা

টেকনাফের উপকূলের শাহপরীর দ্বীপ, গোলারচর ও সিলখালি এলাকা থেকে শুক্রবার ভোরে আটক হওয়া ৩০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন নারী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর।

বিজিবি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ১১ জন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাকি ছয়জনের স্বামী বা স্বজন পাঁচ থেকে ১০ বছর আগে একইভাবে (সাগর পথে) মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া গেছেন।

তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই এই নারীরা মালয়েশিয়া যাত্রা করেছিলেন বলে জানান বিজিবি কর্মকর্তারা।

রোহিঙ্গা কিশোরী রেহেনা বেগম (১৬) বেনারকে বলেন, “গত বছর সেনাদের অভিযানে মুখে আমাদের পরিবার বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তবে আমার বাবা আরও তিন-চার বছর আগে মিয়ানমার থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া গিয়েছেন। তিনি সেখানে বসবাসকারী এক ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন।”

শুক্রবার টেকনাফের বাহাছড়ার শামলাপুর বড় ডেইল এলাকা থেকে আটক ২০ জনের মধ্যে ১৩ জন এবং বৃহস্পতিবার উখিয়ার ডেইলপাড়া থেকে থেকে আটক ২০ জনের মধ্যে ছয়জন নারী।

“বিশেষ করে যাদের আত্মীয়স্বজন আগে থেকেই মালয়েশিয়া অবস্থান করছে, তাদের মাধ্যমেই এখানকার রোহিঙ্গা নারীদের সেখানে বিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,” বেনারকে বলেন লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুল মোতালেব।

মুঠোফোনে মালয়শিয়ায় বিয়ে

গত বছর চাচার সঙ্গে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গা কিশোরী সেহেনা আক্তার (১৫)। তাদের বাড়ি ছিল মংডু টাউনশিপের রাইম্ম্যাবিল গ্রামে।

বিজিবির অভিযানে আটক হওয়ার পর সে বেনারকে জানায়, কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়া অবস্থাকারী এক রোহিঙ্গা যুবকের সাথে তার মোবাইল ফোনে বিয়ে হয়। এরপর থেকেই সে স্বামীর কাছে যাওয়ায় চেষ্টায় ছিল।

লেদা ক্যাম্প ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোতালেবও জানান, মালয়শিয়া বসবাসকারী অনেক রোহিঙ্গা পুরুষের সাথেই ক্যাম্পে বসবাসকারী নারীদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিয়ে হচ্ছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।

“মূলত সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় ‘জীবনের ঝুঁকি’ নিয়ে সমুদ্রপথে মালয়শিয়া যেতে চাচ্ছে রোহিঙ্গারা,” যোগ করেন তিনি। তবে বিজিবি কর্তকর্তা আছাদুদ-জামান বলেন, “অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে যাতে কোনও প্রাণহানী না ঘটে, সে লক্ষ্যে নজরদারী বাড়ানো হয়েছে।”

বিতাড়িত বৌদ্ধ শরণার্থীরা

বাংলাদেশে প্রবেশকারী দুই শতাধিক বৌদ্ধ শরণার্থীকে বান্দরবানের চেইক্ষ্যংপাড়ায় তাড়িয়ে দিয়েছে বিজিবি। তারা এখন দুই দেশের সীমান্তরেখায় মানবেতরভাবে আটকে আছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।

তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “চেইক্ষ্যংপাড়ায় কোনো বৌদ্ধ শরণার্থী প্রবেশ করেছিল, এমন তথ্যই প্রশাসনের কাছে নেই।”

মিয়ানমারের চীন রাজ্য থেকে পালিয়ে ওই শরণার্থীরা গত সপ্তাহের রবিবার থেকে বুধবারের মধ্যে বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম সীমান্ত পথ পেরিয়ে রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের ওই পাড়ায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বান্দরবানের এক বাসিন্দা বেনারকে জানান, বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রবিবার অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই চেইক্ষ্যংপাড়া থেকে শরণার্থীদের জোরপূর্বক সীমান্তের দিকে তাড়িয়ে দেয় বিজিবি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।