বঙ্গোপসাগরে নৌকা ডুবিতে ১৫ রোহিঙ্গা নিহত, নিখোঁজ অর্ধ শতাধিক

আবদুর রহমান ও জেসমিন পাপড়ি
2020.02.11
কক্সবাজার ও ঢাকা
200211-BD-rohingya-1000.jpg কোস্টগার্ডের সেন্টমার্টিন স্টেশনে বসে নিজের পরিচয়পত্র দেখাচ্ছেন ট্রলার ডুবির পর বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া মালয়শিয়াগামী রোহিঙ্গা আবদুল্লাহ। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রাকালে সেন্টমার্টিনের কাছে বঙ্গোপসাগরে একটি ট্রলার ডুবিতে ১৫ রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মর্মান্তিক এই ঘটনায় ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও এখনো ৫১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ১৫ মৃতদেহের মধ্যে ১২ জন নারী ও তিনটি শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছেন কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লে: কমান্ডার সোহেল রানা।

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানান, উন্নত জীবনের আশায় কক্সবাজারের শিবির থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন তাঁরা।

এ ঘটনায় চার পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে বলে জানান সোহেল রানা। আটকৃতরা হলেন, টেকনাফ বাহারছড়া নোয়াখালী পাড়ার ফয়েজ আহম্মদ (৪৮), টেকনাফ সদরের সৈয়দ আলম (২৭), উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আজিম (৩০) ও বালুখালীর ওসমান (১৭)।

কোস্টগার্ড কর্মকর্তা সোহেল রানা বেনারকে বলেন, “মঙ্গলবার ভোরে মুঠোফোনে আবদুল পরিচয়ে একজন যুবক কান্নাকাটি করতে করতে জানায়, অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সেন্টমার্টিনের কাছে নৌকা ডুবে যাচ্ছে।”

তিনি জানান, কোস্ট গার্ডের দুটি দল লোকেশন শনাক্ত করে যখন সেখানে পৌঁছায় ততক্ষণে ট্রলার ডুবে গেছে। পরে সেখান থেকে ৭২ জনকে উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ফোনে বর্ণনা দেওয়া আবদুলও রয়েছেন।

বেঁচে ফেরাদের বর্ণনায় নৌকাডুবি

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে সহসাই স্বাভাবিক হতে পারছেন না উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা নারী আনোয়ারা বেগম (২৮) বেনারকে জানান, মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এবং তাঁর ভাই, বোন ও ভাগনিসহ পরিবারের ৭ জন ওই ট্রলারে উঠেছিলেন।

“কিন্তু ট্রলার ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই সেটি ডুবে যায়। কোস্টগার্ডের হাতে দুই ভাইসহ আমি উদ্ধার হলেও বাকিদের খোঁজ নেই,” বলেন তিনি।

মিয়ানমার থেকে এসে উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারী এই নারী আরও জানান, ওই ট্রলারে থাকা বেশিরভাগ যাত্রীই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা।

নৌকাডুবি থেকে উদ্ধার হওয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো: জুবাইর বেনারকে জানান, “সোমবার রাতে একটি ট্রলারে ১৩৮ জনকে তুলে দেয় টেকনাফ বাহারছড়া নোয়াখালী পাড়ার সৈয়দ আলম ও নুরুল আলম।”

তিনি বলেন, “মঙ্গলবার ভোর রাতে সেন্টমার্টিন অদূরে পশ্চিমে পাথরের সাথে ধাক্কা লাগলে ট্রলারটি ফেটে পানি ঢুকতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে একে একে সবাই তলিয়ে যেতে থাকে।”

জুবাইর বলেন, “পরিবারের কথা চিন্তা করে, উন্নত জীবনের আশায় সাগর পথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছি।”

কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী সেলিনা বেগম বেনারকে বলেন, “শিবিরে বিয়ে করতে চাইলে বর পক্ষকে বড় অঙ্কের যৌতুক দিতে হয়। তা ছাড়া ভালো পাত্র মেলে না।”

“তাই এক আত্মীয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় থাকা রোহিঙ্গা ছেলের সাথে মোবাইলে বিয়ে দিয়েছে পরিবার। তাঁর কথামতো সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম,” বলেন তিনি।

মালয়েশিয়াগামী ওই ট্রলারে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও ছিলেন। ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা মো. আব্দুল (২৮) বেনারকে জানান, ভালো আয়ের আশায় মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন তিনি।

ট্রলারে মাঝি ও দালাল ফয়েজ আহমদ বেনারকে জানান, নুরুল আলম, সৈয়দ আলম ও মো. ইউনুছের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৩৮ জন মালয়েশিয়া যাত্রীকে সাগরে নোঙর করা একটি বড় জাহাজে তুলে দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাসের কারণে তাঁদের সাগরে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

“এ জন্য যাত্রীভর্তি ট্রলার ফেরত আনার সময় সেন্টমার্টিনের অদূরে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়,” বলেন তিনি। পরে ওই মাঝিকে আটক করে পুলিশে দেয় কোস্টগার্ড।

টেকনাফ মডেল থানার অপারেশন অফিসার মোহাম্মদ রকিবুল ইসলাম খান বলেন, “উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে ৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা সবাই রোহিঙ্গা।

ডুবে যাওয়া ট্রলারে বেশিরভাগই রোহিঙ্গা ছিলেন বলে জানান তিনি।

তবে উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে দুইজন বাংলাদেশি নাগরিক বলে জানান সোহেল রানা।

নতুন-পুরাতন পাচারকারীরা জড়িত

মানবপাচার বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুালশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন “এই ট্রলার ডুবির ঘটনার সঙ্গে পুরানো-নতুন দালাল জড়িত রয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”

“দালালরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে টার্গেট করেছে। ফলে ক্যাম্পে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। দালালদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে।”

তিনি জানান, আইনি প্রক্রিয়া শেষে মৃতদেহগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে কবরস্থানে দাফন করা হবে। আর উদ্ধার ভিক্টিমদের নিজ নিজ ক্যাম্পে পাঠানো হবে।

এর আগে গত তিন মাসে একশ'র বেশি মালয়েশিয়াগামীকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। তাঁরা সবাই উখিয়া-টেকনাফের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা।

সর্বশেষ গত ২০ জানুয়ারি টেকনাফ-বাহারছড়া উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়া পাচারকালে ২২ জনকে রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। এর কয়েক দিন আগে উখিয়া-টেকনাফ উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়া পাচারকালে ৭০ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া চার দালালকেও আটক করে পুলিশ।

দুর্দশার জীবন থেকে মুক্তিই লক্ষ্য

আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার এথেনা রেবার্ন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “মিয়ানমারে নির্যাতন এবং বাংলাদেশে দীর্ঘদিন শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে রোহিঙ্গা শিশু ও তাঁদের পরিবার হতাশ হয়ে পড়েছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপজ্জনকভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত এই জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে ফেরত নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে এক যৌথ বিবৃতিতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, কক্সবাজারে অনিয়মিত ও অনিরাপদ নৌযাত্রা নতুন কোনো ঘটনা নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশি উভয়েই বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়ে এই ঝুঁকি নিয়ে থাকেন।

নৌকাডুবির ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে মঙ্গলবার দেওয়া এই বিবৃতিতে সংস্থা দুটি জানায়, সরকারের পাশে থেকে উদ্ধারকৃতদের যে কোনো সহায়তায় তারা প্রস্তুত রয়েছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।