আদালতে পাঠানো ২২ রোহিঙ্গার ৩ দিনের রিমান্ড
2024.02.12
কক্সবাজার ও ঢাকা

মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতের মধ্যে কক্সবাজারে উখিয়া সীমান্ত দিয়ে অস্ত্রসহ বাংলাদেশে প্রবেশ করা ২৩ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২২ জনকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে কক্সবাজারের একটি আদালত। অসুস্থতার কারণে ১ জন রোহিঙ্গাকে আদালতে হাজির করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) নাছির উদ্দিন বেনারনিউজকে বলেছেন, এই ২৩ জনের বিষয়ে তদন্ত শেষ না করে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তারা কেন, কীভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ওপারে গিয়েছিল, কার হয়ে তারা কাজ করছে-সেসব প্রশ্নের জবাব তদন্তের পর পাওয়া যাবে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমারে গিয়েছিল এবং অস্ত্রসহ বাংলাদেশে আবারও ঢোকার চেষ্টা করছিল।
এ প্রসঙ্গে ওসি নাছির উদ্দিন আরও জানান, ২৩ জনই মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক, তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে। তাদের পরিচয় শনাক্ত করার কাজ চলছে।
সোমবার আদালতে হাজির করার পর কক্সবাজার সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট (আদালত-১) শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গা তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
নাছির উদ্দিন মজুমদার বেনারকে বলেন, ৩৪ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পালংখালী বিওপির নায়েব সুবেদার মো. শহিদুল ইসলাম উখিয়া থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করেন। শুনানি শেষে আদালত ২২ জনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
তিনি জানান, তাদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে পাওয়া ১২টি অস্ত্র পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এ্যন্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইস) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়েরের বলেন, “অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ২৩ রোহিঙ্গা হয়তো এখান থেকে (বাংলাদেশ থেকে) সেদেশে আরকান আর্মির সাথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। পুলিশের তদন্তের পর হয়তো বিস্তারিত জানা যাবে।”
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন আমাদের পূর্ণ অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাচ্ছে, তখন আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সংঘর্ষের নাটক মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে।”
এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, “আরাকান আর্মির প্রধান বিবিসির সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের জাতি বলে স্বীকার করেনি। তারা নাকি আমাদের বাঙালি হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু আমরা তো রোহিঙ্গা, বাঙালি নই। আমাদের পূর্ণ অধিকার, মর্যাদা এবং সম্মান দিয়ে প্রত্যাবাসন হলেই আমরা ফেরত যেতে রাজি আছি। আমরা এই মুহূর্তে কোনও পক্ষকেই বিশ্বাস করতে পারছি না।”
নাফ নদীতে বিজিবির কড়া পাহারা
মিয়ানমারের রাখাইনে গোলাগুলি, সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে যাতে রোহিঙ্গারা ঢুকতে না পারে, সে জন্য নাফ নদীতে সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রয়েছে বিজিবি।
স্থানীয়দের মতে, রাখারইন থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গারা জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (বিজিবি-২) অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, “নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গার পাশাপাশি যাতে কোনো ধরনের লোকজন টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সকাল থেকে দমদমিয়ার নাফ নদী সীমান্তে উপ-অধিনায়ক মেজর শহীদুল ইসলামসহ বিজিবির তিনটি স্পিড বোট টহল অব্যাহত রয়েছে।”
এদিকে মিয়ানমারের মংডু থেকে ছোট ছোট ট্রলারে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে কয়েকদিন ধরে সীমান্তে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে কয়েক শ রোহিঙ্গা। তবে একজন রোহিঙ্গাও যাতে সীমান্ত পার হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি।
রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঠেকানো হচ্ছে উল্লেখ করে কর্নেল মহিউদ্দীন বলেন, “বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে লোকজন অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু আমরা নতুন করে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। আজ পর্যন্ত ১৩৭ জনকে প্রতিহত করা হয়েছে।”
সীমান্তে দুটি লাশ উদ্ধার
রোববার পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে আসা অজ্ঞাত পরিচয়ের দুই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ।
কক্সবাজারের উখিয়ায় অজ্ঞাত এক মরদেহ রোববার দুপুরে উপজেলার বালুখালী কাস্টমস এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
মরদেহটি দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা খবর দিলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে।
মরদেহের মাথায় জলপাই রঙের হেলমেট ও পোশাক দেখে স্থানীয়রা ধারণা করছেন, মিয়ানমার বাহিনীর কোনো সদস্যের মরদেহ।
তারা বলেন, মরদেহের মুখে কালি রয়েছে। মাথায় হেলমেট ও গায়ে খাকি পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, এটা মিয়ানমার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কোনো সদস্যের মরদেহ।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতের দিকে রহমতেরবিল সীমান্ত এলাকায় মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। ৭২ ঘণ্টা পর শনিবার স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন বেনারকে বলেন, “লাশ দুটি শনাক্ত করা যায়নি।”
তুমব্রু সীমান্ত থেকে সরানো হবে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র
মিয়ানমারে চলমান সংঘর্ষের জেরে মিয়ানমার অংশ থেকে গুলি এসে পড়ছে বাংলাদেশ। ঘুমধুম ও তমব্রুসহ সীমান্ত এলাকার লোকজন অন্যত্রে চলে গেছে। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে উখিয়া পালংখালী ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা।
পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র সরিয়ে পার্শ্ববর্তী দুইটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
সীমান্ত এলাকার বসবাসরত স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।
বিজিপি ও সেনা সদস্যদের খুব সহসাই ফেরত পাঠানো হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান তুমুল লড়াই ও গোলাগুলির শব্দে সেনাসহ প্রায় ৩৩০ জন বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
সোমবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষী ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্রুততম সময়ে ফেরানো হবে।
তবে তিনি পাঠানোর দিনক্ষণ বলতে রাজি হননি।
“প্রথমত, মিয়ানমার থেকে বর্ডার সিকিউরিটি গার্ড এবং সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এসেছেন, তাদের খুব সহসাই ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। মিয়ানমার তাদের ফেরত নিয়ে যাবে। আমি দিনক্ষণ বলতে চাই না। কারণ, এটা গোপনীয় বিষয়, এখানে নিরাপত্তার বিষয় যুক্ত রয়েছে,” বলেন তিনি।
মিয়ানমার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে এবং তাদের কারণে দেশে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমাদের পক্ষে নতুন করে রোহিঙ্গাদের আর আশ্রয় দেওয়া সম্ভব না। ”