বাংলাদেশে ভালো থাকলেও প্রত্যেক রোহিঙ্গা ফিরে যেতে চায়: জাতিসংঘ কর্মকর্তা

কেইট বেডাল ও মাহবুব লীলেন
2020.03.09
ওয়াশিংটন ডিসি
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
200309_Interview_Richard_Ragan_1000.jpeg ওয়াশিংটন ডিসিতে বেনারনিউজের সাথে সাক্ষাৎকারে কথা বলছেন জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বাংলাদেশ এর আবাসিক প্রতিনিধি রিচার্ড রেগান (ডানে)। ৪ মার্চ ২০২০।
[বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে তাঁদের আদি বাসস্থান রাখাইনের চেয়েও বেশি সুবিধা ও স্বাধীনতা ভোগ করছে। তবুও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘এখানে থাকতে চান নাকি দেশে যেতে চান?’ তাহলে সকল রোহিঙ্গাই একবাক্যে বলবে, “বাড়ি যেতে চাই।”

বেনারের সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে এমনই জানিয়েছেন বাংলাদেশে কর্মরত জাতিসংঘের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মূহূর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোনো আশার আলো দেখতে পান না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

“আপনি যদি রোহিঙ্গা শিবিরে যান, তবে রোহিঙ্গারা আপনাকে বলবে যে, জীবনে প্রথমবারের মতো তাঁরা নিজেদের মুক্ত ও স্বাধীন ভাবতে পারছে, নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারছে, চলাফেরা করতে পারছে, যা করার অনুমতি তাঁদের রাখাইনে ছিল না,” বেনারকে বলেন জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির বাংলাদেশ প্রধান রিচার্ড রেগান।

বুধবার ওয়াশিংটন ডিসির বেনার কার্যালয়ে এক সাক্ষাৎকারে রেগান বলেন, “তারা রাষ্ট্রহীন, নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত, গণ্যহত্যার শিকার। যেসব পরিস্থিতিতে তারা এখানে আসাতে বাধ্য হয়েছে, তা কোনোভাবেই ভালো ছিল না। ওইসব বিবেচনায় এখানে (কক্সবাজারে) তাঁদের জীবন অনেক দিক থেকেই আগের চেয়ে ভালো।”

“কিন্তু তারপরেও শরণার্থী শিবিরে এমন একজন রোহিঙ্গাও পাওয়া যাবে না, যে ফিরতে চায় না। যদি তাঁদের বলা হয়, এখানে থাকবেন নাকি বাড়ি ফিরে যাবেন? তাঁদের প্রত্যেকেই বলবে- আমি বাড়ি যেতে চাই,” বলেন তিনি।

“কিন্তু এখনো সেখানে (রাখাইনে) সেই পরিস্থিতি নেই,” যোগ করেন রেগান।

রাখাইন রাজ্যে এখনো প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা রাখাইনেও প্রায় আড়াই লাখ লোকের (রোহিঙ্গা) দেখাশোনা করি। ...সুতরাং বাংলাদেশে কী হচ্ছে তার পাশাপাশি সীমান্তের অন্যপাশে রাখাইনে কী ঘটছে সে বিষয়েও আমাদের একটা পরিষ্কার ধারণা রয়েছে।”

রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার জন্য রাখাইনে যে স্থিতিশীলতা দরকার তা এখনো তৈরি হয়নি মন্তব্য করে রেগান বলেন, “গত দুই মাসে বরং সেখানে সহিংসতা বেড়েছে। ...ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেখানে যে স্থিতিশীলতা দরকার, কেউই তা দেখতে পাচ্ছে না।”

রোহিঙ্গাদের মধ্যে মিয়ানমার ফিরে যাবার আগ্রহ খুব প্রবল জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা ফিরে যাবে যদি সেখানকার পরিস্থিতি যথেষ্ট নিরাপদ হয়, এবং যদি তাঁদেরকে সেখানে জীবনযাপনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়।”

“কিন্তু এখনো আমি খুব একটা আশার আলো দেখি না,” বলেন রেগান।

শরণার্থীদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করাই তাঁর সংস্থার প্রধান কাজ উল্লেখ করে রেগান বলেন, মিয়ানমারকে দায়বদ্ধ করাই এখন বাংলাদেশর প্রধান কাজ হওয়া উচিত।

“শরণার্থী শিবিরে এমন একজনও নেই যার ওপর ভয়াবহ কিছু না কিছু ঘটেনি,” মন্তব্য করে রেগান বলেন, “যা ঘটেছে তা ভুলতে দেওয়া যাবে না।”

কক্সবাজার: অনন্য শরণার্থী ব্যবস্থাপনা

রেগান জানান, শরণার্থী শিবিরের প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ ব্যবস্থাপনা করে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, এবং এইসব খাদ্যের সবটাই বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য।

প্রথাগতভাবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে যেভাবে লোকজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে খাদ্য বিতরণ করা হয়, কক্সবাজারের সরবরাহ প্রক্রিয়া তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে জানান রেগান।

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যেককে প্রতি মাসে নয় ডলার সমপরিমাণ অর্থ তাঁদের ই-ভাউচারে দিয়ে দেয়া হয়। শিবিরগুলোতে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার স্থাপন করা নির্ধারিত দোকান রয়েছে। শরণার্থীরা সেইসব দোকান থেকে ই-ভাউচার দিয়ে মাছ, সবজি, ডিমসহ ১৯ প্রকারের খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারেন, যা প্রথাগত শরণার্থী সরবরাহ ব্যবস্থায় দেখা যায় না।

“এর আরেকটা সুবিধার দিক হলো, এই সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত সকলেই বাংলাদেশি ব্যবসায়ী,” মন্তব্য করে রেগান জানান, এই ব্যবস্থায় কক্সবাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাও যুক্ত রয়েছেন।

শরণার্থীদের খাদ্য সরবরাহ খাতে প্রতি মাসে আনুমানিক ৬০ লাখ মার্কিন ডলার প্রবাহিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত লোকজনের জন্য এটি একটি বিশাল ব্যবসায়িক সুযোগও বটে।”

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শরণার্থীদের সাথে ২০ বছরের বেশি কাজ করার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির সম্পর্কে রেগান বলেন, “এটি শুধু বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরই নয়, এটি সম্ভবত আমার দেখা বিশ্বের সবচেয়ে অনন্য শরণার্থী ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার একটি। ...এবং সজীব ও সক্রিয়।”

২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিশাল আকারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটার পর প্রথম দুই বছর তাঁদের কার্যক্রম মূলত জীবনরক্ষাকারী সহায়তা ও পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার কর্মসূচি ছিল বলে জানান রেগান।

তবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তৃতীয় বছরে, বর্তমানে তাঁরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর এই বিশালসংখ্যক শরণার্থীর প্রভাবকে মানানসাই করার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।

“আমাদের এখন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ শরণার্থীদের এই বিশাল চাপের একটা বড় অংশ তাঁদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ... এগুলো তাঁদের জায়গা, তাঁদের সুযোগ সুবিধা, যা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে,” বলেন রেগান।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের জনসংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ তৈরি করেছে মন্তব্য করে রেগান বলেন, “অনেক দিক থেকে এটি তাঁদের জন্য সুযোগও নিয়ে এসেছে। ওইসব এলাকার উন্নয়নের জন্য অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে, যা ইতিবাচক।”

ভাসানচর: ব্যয়বহুল হবে ব্যবস্থাপনা

উখিয়া ও টেকনাফের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

সম্পূর্ণ বাংলাদেশের অর্থায়নে ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা করলেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাতে সম্মতি দেয়নি, ফলে সে পরিকল্পনা পিছিয়ে যায়।

বর্তমানে সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাস উপযোগী ঘরবাড়ি প্রস্তুত হয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর মতামত জানতে চাইলে রেগান বলেন, ভাসানচর রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য উপযুক্ত কি না সে বিষয়ে কারিগরি মূল্যায়নে সরকারকে সহায়তা দেবার জন্য তাঁরা প্রস্তুত রয়েছেন।

তিনি বলেন, “এখানে কয়েকটি মূল বিষয় রয়েছে, প্রথমত, এটি (স্থানান্তর) হতে হবে স্বেচ্ছায়। দ্বিতীয়ত, লোকজন সেখানে কী কী প্রত্যাশা করতে পারে সে বিষয়ে পরিষ্কার একটা চিত্র থাকতে হবে।”

“তৃতীয়ত, এটা মানতে হবে যে, স্থানান্তরের পরে তা হবে বেশি ব্যয়বহুল। কারণ, যখনই লোকজনকে ভাগ করে একটা অংশকে চরে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন আমাদের ব্যবস্থাপনা খরচ বেড়ে যাবে,” বলেন রেগান।

তিনি বলেন, “এবং সেটা বঙ্গোপসাগর, সাইক্লোনের স্থান। বড়ো ভয় হচ্ছে, যদি সমুদ্র থেকে কিছু ধেয়ে আসে তখন কী হবে?”

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) রাখাইন রাজ্যের বেশ কয়টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা বসতিগুলোর ওপর ব্যাপক পীড়নমূলক অভিযান শুরু করে। যার ফলে প্রায় সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

এর আগে থেকেও বিভিন্ন সময় রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে আরো চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। সব মিলে বর্তমানে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সহায়তাকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত দেশটি রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য মোট ৮২ কোটি মার্কিন ডলার দিয়েছে, যার মধ্যে ৬৯ কোটি ৩ লাখ ডলার দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কর্মসূচির জন্য।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশ কাজ করে। সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয়ের আবাসিক প্রতিনিধি রিচার্ড রেগান সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সহায়তা ও বিভিন্ন নীতিগত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মতর্তাদের সাথে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটন ডিসি সফর করেন। তাঁর এই সফরের সময় গত ৪ মার্চ তিনি বেনারনিউজকে এই সাক্ষাৎকারটি দেন।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আশীফ এন্তাজ রবি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।