মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের আগে ওই দ্বীপ পরিদর্শনের অনুমতি চেয়েছিল জাতিসংঘ। চলতি সপ্তাহে সেই অনুমতি পেতে যাচ্ছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
যদিও এতদিনে ওই দ্বীপে রোহিঙ্গা বাসিন্দার সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১৪ হাজার।
সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, সরকার অনুমোদন দিলে, জাতিসংঘ প্রায়োগিক এবং সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়ন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মাদ দেলোয়ার হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থানান্তর ও সেখানে তাঁদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের সাথে আমাদের আলাপ-আলোচনা চলছিল। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গল বা বুধবার তাঁদের সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে।”
ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ।
গত সপ্তাহের মাঝামাঝি এ বিষয়ে সরকারের আশ্বাস পাওয়া গেছে জানিয়ে সাজ্জাদ বলেন, “প্রতিনিধি দলটিতে কারা থাকবেন, কবে যাবেন বা সেখানে কতদিন থাকবেন,” এসব বিষয়ে তিনি এখনো অবগত নন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকাস্থ জাতিসংঘ তথ্যকেন্দ্রের (ইউএনআইসি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বেনারকে জানান, “আমাকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।”
এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ভাসানচর পরিদর্শন করেছিলেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। তখনো কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য দ্বীপটি প্রস্তুত হয়নি।
সংক্ষিপ্ত পরিদর্শন শেষে দ্বীপটিতে আবাসন পরিকল্পনা শুরুর আগে জাতিসংঘকে সেখানে “পূর্ণাঙ্গ কারিগরি, মানবিক ও নিরাপত্তা সমীক্ষা চালাতে অনুমতি দেওয়ার” জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
তবে সে ধরনের কোনো সমীক্ষা ছাড়াই এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তি উপেক্ষা করে গত ডিসেম্বর থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করে সরকার।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বশেষ চলতি মার্চের শুরুতে ভাসানচর পরিদর্শন করে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি’র একটি প্রতিনিধিদল।
পরিস্থিতি বুঝে করণীয় ঠিক হবে
বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় দুই দশক আগে জেগে ওঠা নোয়াখালীর ওই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটি শরণার্থীদের বসবাসের উপযোগী কিনা তা যাচাইয়ে জাতিসংঘকে মূল্যায়নের সুযোগ না দিয়ে সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং দাতাগোষ্ঠী শুরু থেকেই সরকারের এ উদ্যোগের বিরোধিতা করার পাশাপাশি জাতিসংঘকে স্বাধীনভাবে দ্বীপটির কারিগরি ও সুরক্ষা মূল্যায়ন করতে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
চলতি সপ্তার সফরে জাতিসংঘ ভাসানচরের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার সুযোগ পাবে কিনা জানতে চাইলে ডিজি দেলোয়ার বলেন, “তারা সেখানে যেসব রোহিঙ্গা আছেন তাঁদের সার্বিক অবস্থা দেখবে। এর বাইরে বিস্তারিত বলতে পারব না।”
“সেখানে গেলে তারা হয়তো পরিস্থিতি বুঝে করণীয় ঠিক করবেন,” বলেন ডিজি।
আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর বিরোধিতার মুখেই গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার।
বর্তমানে সেখানে ১৪ হাজারের বেশি শরণার্থী বসবাস করছেন উল্লেখ করে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন সোমবার বেনারকে জানান, স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হলে রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো হবে।
আরআরআরসি কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বর থেকে পাঁচ দফায় ভাসানচরে গেছেন মোট ১৩ হাজার ৭২৩ জন রোহিঙ্গা। এর আগে গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে সেখানে নিয়ে রাখা হয়।
এ ছাড়া এর মধ্যে ভাসানচরে ৩৪ টি রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। সব মিলে বর্তমানে দ্বীপটিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৩ জন।
স্থানান্তরের কাজে সরকারের পাশে দাঁড়ানো স্থানীয় ২২টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) বেশ সন্তোষজনকভাবেই খাবারসহ সার্বিক মানবিক সহায়তা দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন অতিরিক্ত আরআরআরসি।
জাতিসংঘ এ কাজে জড়িত হলে পরিস্থিতি কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিষয়টি তখন বলা যাবে।”
টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের নতুন শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোস্তফা কামাল জানান, জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল ভাসানচরে গেলে সেটি রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো খবর। সেখানকার পরিস্থিতি দেখে তারাই রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারবে।
“কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোয় এখনো যারা ভাসানচরে যাওয়া-না যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতা ভুগছে, জাতিসংঘের মতামত তাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে,” বেনারকে বলেন তিনি।
জাতিসংঘের অংশগ্রহণ ‘গুরুত্বপূর্ণ’
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়া নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে বেনারকে জানান, প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল আসছে, এমন খবর সেখানকার রোহিঙ্গাদের কাছেও পৌঁছেছে। তাই নানা প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে।
“তাদের কাছে আমরা এখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরব। কারণ তারাই শরণার্থীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবার ভরসাস্থল। অনুরোধ করব তারা যাতে এখানকার সকল কার্যক্রমে যুক্ত থাকে,” বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে নুরুল বলেন, “ভাসানচরে বড়ো ধরনের রোগের চিকিৎসা সেবা ছাড়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। সবরকম স্বাস্থ্য সেবা যাতে এখানে পাওয়া যায় সেই দাবি জানাব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের মতে, “নিঃসন্দেহে এটা একটা ইতিবাচক পরিবর্তন। কারণ সরকারের এমন একটি উদ্যোগে জাতিসংঘের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি ছিল।”
তাঁর মতে, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের উদ্দেশ্য একই। মানবতার জায়গা থেকেই দুই পক্ষ কাজ করছে।
“আমার মনে হয়, জাতিসংঘ এখন একটা প্রায়োগিক অবস্থানে যাবে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সহযোগিতার যে ধারাটি আছে সেটি বজায় থাকবে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পর্কের ভিত্তি আরও মজবুত হবে,” যোগ করেন ড. দেলোয়ার।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। আগের ও তখনকার মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছেন।
ওই বছরের নভেম্বর মাসে কক্সবাজার থেকে এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে।
কিন্তু ২০১৮ সালে যখন প্রথম তাঁদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হয়, তখন থেকেই রোহিঙ্গারা সেখানে যাবার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাঁচ দফায় যেসব রোহিঙ্গাকে নেওয়া হয়েছে, তাঁরা স্বেচ্ছায় সেখানে যাওয়ার কথা বলেছেন।
কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।