মিয়ানমারে গণহত্যা: নাগরিকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় সামরিক সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের পথ সুগম হবে

বেনারনিউজ বিশেষ প্রতিবেদন
2022.03.23
মিয়ানমারে গণহত্যা: নাগরিকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় সামরিক সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের পথ সুগম হবে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে বাঁচতে চার সহোদর শিশু একে অন্যের হাত ধরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছে। ১ নভেম্বরে ২০১৭।
[রয়টার্স]

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর চালানো নিপীড়নকে প্রথমবারের মতো ‘গণহত্যা' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন মিয়ানমারে জনগণ।

তবে এই সময়ে এই ঘোষণা কেন, এমন প্রশ্ন রয়েছে জনমনে। তা ছাড়া এই স্বীকৃতি কি শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি মানবাধিকার হরণ করা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন আরো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেবে এমন প্রশ্নও রয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন গত সোমবার ঘোষণা করেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংসতা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা।

তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা, গণধর্ষণ, অঙ্গচ্ছেদ, শিশুদের পুড়িয়ে এবং ডুবিয়ে হত্যা করা, ক্রুশবিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন নৃশংসতা চালিয়েছে সেনাবাহিনী। এমন নৃশংসতা জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর নৃশংসতায় হাজারো রোহিঙ্গা মারা যান এবং সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এর আগে থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।

তবে বিবৃতিতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মার্কিন ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এই ধরনের পর্যবেক্ষণ ‘বাস্তবতা থেকে বহুদূরে’। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল’ বলে মন্তব্য করেছে কর্তৃপক্ষ।

সেনা সমর্থিত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় উঠেপড়ে লেগেছেন ইতিমধ্যে। দেশটির সেনাসমর্থক হিসেবে পরিচিত ব্লগার কিউ সওয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টেলিগ্রাম পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা তাদের মেরেছি। দেখি তোমরা কী করতে পারো।”

তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে মিয়ানমারে ইস্যুতে চুপ থাকতে এবং ইউক্রেনে রুশ হামলা ঠেকানোর বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে পরামর্শ দেন।

তবে অধিকাংশ মানুষই মার্কিন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং তাঁদের প্রত্যাশা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেবে ওয়াশিংটন। মিয়ানমারের অধিকাংশ নাগরিক সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। কারণ ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেনাবাহিনী অন্তত এক হাজার ৬৮৭ বেসামরিক ব্যক্তিতে হত্যা করেছে, কারান্তরীণ করা হয়েছে নয় হাজার ৭৭৩ জনকে।

বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দা উইন অং বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণায় তিনি সন্তুষ্ট। তবে গণহত্যার এই স্বীকৃতি আরো আগে দেওয়ার দরকার ছিল। তিনি বলেন, “রাখাইন রাজ্যেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার একমাত্র ঘটনা নয়। দেশের অন্যান্য স্থানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর এমন আরও অনেক নৃশংসতা চালিয়েছে সেনাবাহিনী।”

জান্তা সরকার বর্তমানে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে আদিবাসী সশস্ত্র বিদ্রোহীগোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াই করছে। এ ছাড়া গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় সেনাবাহিনীর সংঘাত বাঁধছে। সেসব এলাকায় বেসামরিক নাগরিকেরা সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

উইনের মন্তব্য, সেনাবাহিনীর ওপর পশ্চিমা সরকারগুলোর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন ছিল। তবে এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে জান্তা সরকার কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়া হাল ছেড়ে দেবে, এমন ধারণা করার কোনো কারণ নেই।

“যুক্তরাষ্ট্র এখন কী পদক্ষেপ নেয়, সারা বিশ্ব সে দিকেই তাকিয়ে। গণহত্যার স্বীকৃতির সময় নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। তবে আমি মনে করি, এই ঘোষণার প্রভাব জান্তা সরকারের ওপর পড়বেই। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে জান্তা সরকারে আত্মপক্ষ সমর্থনে বড়ো ধরনের ধাক্কা দেবে মার্কিন ঘোষণা,” বলেন উইন অং।

২০১৯ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে গাম্বিয়া। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশেই ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংসতা চালিয়ে মিয়ানমার গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে-এমন অভিযোগ তুলে মামলাটি করেছে গাম্বিয়া।

ইয়াঙ্গুনের তরুণী সু মিয়েতের মতে, গণহত্যা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি যথাযথ, তবে এমন ঘোষণা আরও আগে প্রয়োজন ছিল। কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এমন নৃশংসতার শিকার কেবল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নয়।

এর আগেও সেনাবাহিনী বিভিন্ন এলাকার জনগোষ্ঠীর ওপর এমন নৃশংসতা চালিয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মমতা শুরু পর থেকে অন্যান্য ঘটনাও প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি কাচিন ও কাইন নৃগোষ্ঠীও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ তুলেছে।

কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির। ২৫ আগস্ট ২০২১। [এএফপি]
কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির। ২৫ আগস্ট ২০২১। [এএফপি]

আরও পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান

সোমবার গণহত্যার স্বীকৃতির ঘোষণার আগে ওয়াশিংটন এই নৃশংসতাকে ‘জাতিগত নির্মূল’ হিসেবে অভিহিত করে আসছিল। ‘গণহত্যা’ স্বীকৃতি ‘জাতিগত নির্মূল’ শব্দবন্ধের তুলনায় অনেক দৃঢ় এবং এর আইনি প্রভাবও ব্যাপকতর। গণহত্যা কনভেনশন গণহত্যার সংজ্ঞা করতে গিয়ে বলেছে, একটা জাতি, নৃতাত্ত্বিক, গোত্র বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংগঠিত কার্যক্রম।

অ্যান্টনি ব্লিনকেন সোমবার ওয়াশিংটনের হলোকস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম পরিদর্শন করে বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের পর মিয়ানমার নিয়ে আটবার গণহত্যার স্বীকৃতি দিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। এর আগে বসনিয়া (১৯৯৩), রুয়ান্ডা (১৯৯৪), ইরাক (১৯৯৫), দার্ফুর (২০০৪), এবং ২০১৬ ও ২০১৭ আইএস অধিকৃত এলাকায় সংগঠিত নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

মান্দালয় শহরের তরুণ অধিবাসী তেত মিয়েত অং বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা ধারাবাহিক ও কার্যকর পদক্ষেপের অংশ হওয়া উচিত। আমরা গণহত্যার স্বীকৃতির ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাই। আগামীতে আরও বাস্তবসম্মত ও অর্থবহ পদক্ষেপের প্রত্যাশা করি।”

মিয়েত অং বলেন, জান্তা সরকারের কর্তারা হয়তো ভাবতে পারে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের অপরাধের জবাবদিহি এড়িয়ে যাবে। তবে এমনটি হবে না। অপরাধের জন্য সাজা ভোগ করতেই হবে।

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা

মিয়ানমার ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষের দেশ। আয়তন প্রায় ফ্রান্সের সমান। ১৩৫টি জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি দেয় মিয়ানমার। জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বর্মি। রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি দেয় না দেশটি। দশকের পর দশক ধরে তারা নানা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। তাঁদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না দেশটির সরকার।

অং সান সুচির বেসামরিক সরকারের শাসনামলে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা হয়েছে। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে সুচি নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন।

২০১৬ সালের নিপীড়নের পর থেকে রোহিঙ্গা হ্লা কিউ সিত্তে শহরে মুসলিম শরণার্থী শিবিরে থাকেন। তিনি আরএফএকে বলেন, “মিয়ানমারে আইন আছে। কিন্তু আইন কেউ মানেনি। এসব (গণহত্যা) কাম্য ছিল না। আমরা আশা রাখি, আগামীতে মুক্তির স্বাদ পাব। আমাদের সন্তানেরা উন্নত জীবন পাবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।