রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য সহায়তা কমাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের সমালোচনা
2022.04.13
ঢাকা ও কক্সবাজার
কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে খাদ্য সহায়তা কমানো হবে—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
তাঁদের মতে, খাদ্য সহায়তা কমানো-বাড়ানোর ওপর জন্মহার নির্ভর করে না। খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিলে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
রোববার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কমিটির সভায় রোহিঙ্গাদের ক্রমবর্ধমান জন্মহার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তাঁদের জন্য রেশন কমানোর কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের বয়স যাই হোক না কেন তারা সবাই সমান খাবার পায়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং একটি নবজাতকের জন্য সমান রেশন দেয়া হয়। সেজন্য তারা বেশি বাচ্চা নেয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বছর ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নেয়।”
তিনি বলেন, “সেজন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রোহিঙ্গাদের খাবারের পরিমাণ কমাতে হবে। বিভিন্ন সংস্থা যারা আছে তারা এ ব্যাপারে একটি মান নির্ধারণ করবে।”
“রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ দরকার,” জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এবং নবজাতক তো সমান খাদ্যগ্রহণ করে না। খাদ্যের জন্য রোহিঙ্গারা বেশি সন্তান নেয় বলে আমরা জানতে পেরেছি।”
রোহিঙ্গা শিশু জন্মের পরিসংখ্যানের কোনো সূত্র উল্লেখ করেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে কক্সবাজারে মানবিক সহায়তা দেয়া জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি করা সংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনারের দপ্তরের সাথে সমন্বয় করে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবরাহ দেখভাল করে বলে বেনারকে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসু দ্দৌজা।
এর সাথে আরো অনেকগুলো সংস্থা নানাভাবে সেবা দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, খাবারের পরিমাণ নির্ধারণের ব্যাপারে সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন,“শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের খাবারের জন্য ফুড কার্ড দেওয়া আছে। এটা পরিবারভিত্তিক। পরিবারের প্রতি সদস্য খাবারের জন্য মাসে ৯৮০ থেকে ১০২০, কখনও ১০৩০ টাকা পায়। এই টাকায় চালসহ প্রায় ২০ প্রকার খাবার আইটেম তারা নিতে পারে।”
মাসের শুরুতে রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত কার্ডে টাকা রিচার্জ করে দেওয়া হয়। এরপর তাঁরা ক্যাম্পভিত্তিক বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অনুমোদিত খাদ্য সরবরাহ সেন্টার থেকে খাবার গ্রহণ করেন বলে জানান শামসু দ্দৌজা।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবিরের ব্যবস্থাপনা, সমন্বয় কমিটির সভায় খাবার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি বলে জানান তিনি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গারা প্রাপ্ত রেশনের কিছু অংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের বিষয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) সঙ্গে টেলিফোনে এবং ই-মেইলের মাধ্যমে মঙ্গল ও বুধবার কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
মাথাপিছু বরাদ্দ ‘পর্যাপ্ত নয়’
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর সেক্রেটারি মো. জুবায়ের বেনারকে বলেন, “বর্তমানে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু যে খাবার দেওয়া হচ্ছে তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। ক্যাম্পগুলোতে দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে কারণে রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ এবং আয় রোজগার কমে গেছে।”
তিনি বলেন, “একটি পরিবারের প্রতি সদস্যের জন্য মাসে ১৩ কেজি চালসহ ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, হলুদ, কাঁচা শাকসবজি, ফলসহ সর্বসাকুল্যে ১০২০ থেকে ১০৩০ টাকা মাথাপিছু বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা কোনোভাবে পর্যাপ্ত নয়।”
শিশু ও বয়স্কদের একই পরিমাণ খাবার বরাদ্দের কারণে শিবিরে জন্মহার বেশি-এই যুক্তি সঠিক নয় জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতা মো. নূর বেনারকে বলেন, “১১ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বছরে ৩০ হাজার নতুন শিশুর জন্ম নেওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
‘আঘাত আসবে নারী ও শিশুদের ওপর’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে যে পরিমাণ খাদ্য সহায়তা দেয়া হয় সেটি খুব সামান্য পরিমাণ, যা দিয়ে তাঁরা কোনোভাবে জীবন বাঁচাতে পারে। সেকারণে এসব দরিদ্র মানুষের অনেকেই হয়তো চিন্তা করেন যে সন্তান বেশি হলে খাদ্য সহায়তা বেশি পাওয়া যাবে।”
তিনি বলেন, “তবে আমি মনে করি রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কোনোভাবেই কমানো উচিত নয়।”
“খাদ্য সহায়তা কমালে এর মূল আঘাত আসবে নারী ও শিশুদের ওপর। খাবার যখন কম মিলবে তখন মহিলারা না খেয়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের খাওয়াবে। এর ফলে মহিলারা অপুষ্টিতে ভুগবে এবং তাঁদের সন্তানরাও অপুষ্টিতে ভুগবে,” বলেন অধ্যাপক মিজান।
“জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্য সহায়তা না কমিয়ে বরং রোহিঙ্গাদের রাজি করিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “জোর করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জোর করে জন্মহার কমানোর ক্ষতিকর উদাহরণ রয়েছে।”
রোহিঙ্গাদের ‘কাজ দিতে হবে’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খানের মতে, “খাবার কমালে জনসংখ্যা কমে যাবে-এমনটি ভাবার কারণ নেই। বরং, খাবার কমালে জনসংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিভিন্ন দরিদ্র দেশে দেখা যাবে, যেখানে ক্ষুধা বেশি সেখানে জনসংখ্যা বেশি।”
“বাংলাদেশে জনসংখ্যার হার কমানোর জন্য যেসব কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো রোহিঙ্গা শিবিরে বাস্তবায়ন করলে সেখানে জনসংখ্যা কমানো সম্ভব হবে,” বেনারকে বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা কমাতে হলে তাঁদের কাজ দিতে হবে। তাঁদের বসিয়ে বসিয়ে না খাইয়ে যদি কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা যায় তাহলে আমি মনে করি জনসংখ্যার হার ধীরে ধীরে কমে আসবে।”
“রোহিঙ্গাদের জন্মহার তুলনামূলক বেশি” বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য্য।
তিনি জানান, জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য দেশি বিদেশি সংস্থার পাশাপাশি সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ সেখানে কাজ করছে। এ বিষয়ে তাদের সচেতন করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে “কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অশিক্ষা” জন্মহার বেশি হওয়ার কারণ বলে জানান পিন্টু।
“এসব গোঁড়ামি দূর করার জন্য সপ্তাহে দুইদিন ঘরে ঘরে গিয়ে আমাদের কর্মীরা কাউন্সেলিং করে। এ সময় তারা পরিবার পরিকল্পনার অস্থায়ী পদ্ধতি যেমন খাওয়ার বড়ি, পিল, ইনজেকশন ও কনডম বিতরণ করে,” বলেন তিনি।
তবে তিনি জানান, শুরুর দিক অর্থাৎ ২০১৭-১৮ সালের তুলনায় বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতনতা অনেকাংশে বেড়েছে। বর্তমানে অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন।