মালয়েশিয়া যাত্রা ব্যর্থ, দুই মাস সাগরে ভেসে ফিরলেন প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গা

আবদুর রহমান ও জেসমিন পাপড়ি
2020.04.16
কক্সবাজার ও ঢাকা
200416-BD-Rohingya-wire-620.jpg মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে দুই মাস সাগরে ভেসে ফিরে আসার পর টেকনাফের মিয়ানমার-বাংলাদেশ ট্রানজিট ঘাটে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের একাংশ। ১৬ এপ্রিল ২০২০।
[এপি]

আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২০ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৫.৪৫

অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছালেও দেশটিতে প্রবেশ করতে না পেরে কক্সবাজারে ফিরে আসা ৩৯৬ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। ওই দলের সঙ্গে থাকা অন্তত ৩০ রোহিঙ্গা খাবার ও পানি সংকটে মারা গেছেন।

ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন) মেজর রুবায়াৎ কবীর বেনারকে এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, ৫৮ দিনের যাত্রায় অন্তত ৩০ জন মারা গেছেন। মৃতদের লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ফিরে আসা রোহিঙ্গারা।

বুধবার রাত নয়টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া জাহাজপুর ঘাট থেকে কিছুটা দূরে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের সহায়তায় রোহিঙ্গা বোঝাই মাছ ধরার ট্রলারটি উদ্ধার করা হয়।

টেকনাফ স্টেশন কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তা লে. কমান্ডার এম. সোহেল রানা উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে বলেন, রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারটি ৫৮ দিন ধরে সাগরে ভাসছিল। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে শিশু ৬৪, নারী ১৮২ ও পুরুষ ১৫০ জন। খাবারের অভাবে এদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

সোহেল রানা বলেন, “তাঁদের উদ্ধারের পর চারটি ট্রাকযোগে টেকনাফের বাংলাদেশ-মিয়ানমার ট্রানজিট ঘাটে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের শুকনো খাবার এবং অসুস্থদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।”

বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁদের জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ইউএনএইচসিআর'র মুখপাত্র লুইস ডনোভান বেনারকে জানান, ৩৯৬ রোহিঙ্গাকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তাঁদের নিজ নিজ শরণার্থী শিবিরে ফেরত পাঠানো হবে।

“আমাদের সীমান্ত খুব বিশাল, তাই মাঝে মধ্যে মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। তবু সীমান্ত পাহারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্তক অবস্থানে রয়েছে,” এক প্রশ্নের জবাবে বলেন সোহেল রানা।

সাগরে দুই মাস

বেনার প্রতিবেদক উদ্ধার হওয়া চারজন রোহিঙ্গার সাথে কথা বলেছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, চার শতাধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে দালালদের মাধ্যমে ছোট নৌকায় করে রওয়ানা হন। তাঁরা মধ্য সাগরে অপেক্ষায় থাকা বড় মাছ ধরার ট্রলারে ওঠেন। সেখান থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের মো. জোবাইর বেনারকে জানান, প্রায় দুই মাস আগে তাঁরা একটি বড় ট্রলারে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। মালয়েশিয়ার সীমান্তে পৌঁছালেও কড়াকড়ির কারণে দেশটিতে তাঁরা প্রবেশ করতে পারেননি।

এরপর থেকে রোহিঙ্গা দলটি সাগরে ভাসছিল। ট্রলারে খাবার ও পানির অভাবে ডায়রিয়া হয়ে ৩০ জন মারা গেছেন বলে জানান জোবাইর। তবে এই সংখ্যা দু’একজন বেশি বা কম হতে পারে বলে জানান তিনি।

রোকেয়া নামে এক রোহিঙ্গা কিশোরী জানান, দুই মাস আগে রওনা হওয়ার সাত–আট দিনের মাথায় তাঁরা মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছান। কিন্তু দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাঁদের ডাঙায় উঠতে দেয়নি। এরপর তাঁদের ট্রলারটি থাইল্যান্ডের কাছাকাছি অবস্থান নেয়।

রোকেয়া জানান, কিছু দিন পর দ্বিতীয় দফায় মালয়েশিয়া সীমান্তে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তাঁরা। ততদিনে ট্রলারের খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় অনেকেই দুর্বল হয়ে পড়েন। ক্ষুধায় ধৈর্য্য হারিয়ে অনেকেই দালালদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।

থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে দালালদের মাধ্যমে কিছু খাবার সংগ্রহ করা হয় জানিয়ে রোকেয়া বলেন, “ট্রলারে মাত্র এক বেলা খাবার ও পানি দেওয়া হতো। অনেকে খাবার ও পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। তাঁদের মরদেহ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।”

সাগর পথে মালয়েশিয়া যাত্রা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের উদ্ধারের পর শরণার্থী শিবিরে ফেরত পাঠানোর আগে টেকনাফের মিয়ানমার-বাংলাদেশ ট্রানজিট ঘাটে রাখা হয়। ১৬ এপ্রিল ২০২০।
সাগর পথে মালয়েশিয়া যাত্রা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের উদ্ধারের পর শরণার্থী শিবিরে ফেরত পাঠানোর আগে টেকনাফের মিয়ানমার-বাংলাদেশ ট্রানজিট ঘাটে রাখা হয়। ১৬ এপ্রিল ২০২০।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

তিন দেশ ঘুরে বাংলাদেশে

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উদ্ধারকৃতদের বরাত দিয়ে কোস্ট গার্ড জানায়, ৫৮ দিন সাগরে ভাসতে থাকা ট্রলারটি প্রথমে মালয়েশিয়ান কোস্ট গার্ড আটক করে। তাঁদের কিছু খাবার, পানি ও জ্বালানী দিয়ে ফেরত পাঠায়। পরে তাঁরা মিয়ানমারে প্রবেশের চেষ্টা করলে সেদেশের নৌবাহিনী তাঁদের আটক করে বাংলাদেশের দিকে পাঠিয়ে দেয়।

নৌকায় থাকা বালুখালী ক্যাম্পের মো. সাদেক বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের আকিয়াবের একটি গরু বহনকারি ট্রলারে আমরা মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। দেশটিতে পৌঁছালেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এরপর থেকে আমরা সাগরে ভাসতে থাকি। এক পর্যায়ে খাবার শেষ হয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “এই দুই মাসে খাবারের অভাবে প্রায় ৩০ জন পুরুষ মারা গেছেন। মৃতদেহগুলো সাগরে ফেলে দেওয়া হয়।”

টেকনাফের মৌচনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মাজেদ ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। তিনি জানান, “উন্নত জীবনের আশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।”

এর আগে গত ফেব্রয়ারিতে ১৩৮ জন যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সেন্টমার্টিনের পশ্চিমে একটি ট্রলার ডুবে যায়। ওই ঘটনায় ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধারের পাশাপাশি ১৬ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নিখোঁজ রয়েছেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ

সমুদ্রপথে দুই মাসের চেষ্টায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে না পেরে বঙ্গোপসাগরে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গাদের শোচনীয় অবস্থার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সেভ দ্যা চিলড্রেন।

ওই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক বিরাজ পাটনায়েক এক বিবৃতিতে বলেন, প্রথমে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার ও পরে মালয়েশিয়া থেকে ফিরিয়ে দেয়ায় চারশ রোহিঙ্গার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।

“ওই দুই সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে দুই মাস সাগরে ভাসতে থাকা ৩২ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। যারা বেঁচে ফিরেছেন তাঁদের এখন তাৎক্ষণিক চিকিৎসা, পর্যাপ্ত খাদ্য ও আশ্রয় প্রয়োজন,” তিনি বলেন।

কক্সবাজারের ঘণবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি থাকার কথা উল্লেখ করে বিরাজ পাটনায়েক বলেন, উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা যাতে এসব ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত থাকেন সেদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।

এদিকে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের সাথে থাকা ৬৪ টি শিশুর জন্য উদ্বেগ জানিয়ে সেভ দ্যা চিলড্রেন এর অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার অ্যাথেনা রেবার্ন বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, “পৃথিবীর সবচে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে রোহিঙ্গা শিশুরা অন্যতম।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে বেঁচে আসলেও বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির শিশুদের জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। এখানে শিক্ষা ও অন্যান্য জরুরি সুযোগ খুব সীমিত। এখানে শিশুরা নির্যাতন ও সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে।”

“এই পরিস্থিতিকে এখন আরো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে শরণার্থী শিবিরে করোনাভাইরাসের আশঙ্কা,” বলেন রেবার্ন।

 

 

আরেকটি নৌকা ফিরিয়ে দিয়েছে মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ার ডাঙায় উঠতে ব্যর্থ হয়ে প্রায় চারশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ফিরে আসার পর দেশটির বিমান বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা বোঝাই আরেকটি নৌকার তাদের ভূখণ্ডে ওঠা প্রতিহত করেছে।

এক ফেসবুক বিবৃতিতে মালয়েশিয়ার বিমান বাহিনী জানায়, “তাঁরা যেসব জায়গা থেকে আসছেন, সেসব জায়গায় তাঁদের জীবন যাপনের শোচনীয় অবস্থা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছেন, ভূমি বা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টারত শরণার্থীরা এখানে নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারেন।”

বিবৃতিতে বলা হয়, বিমান বাহিনী মালয়েশিয়ার সমুদ্র সীমার কাছে ট্রালারটি দেখতে পেয়ে দেশটির নৌবাহিনীকে জানায়। পরে নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ সেখানে গিয়ে নৌকাটির মালয়েশিয়ার জলসীমায় প্রবেশ প্রতিহত করে।

তবে নৌকাটিকে মালয়েশিয়ার জলসীমা থেকে বের করে দেবার আগে নৌবাহিনী ‘মানবতার খাতিরে’ নারী ও শিশুসহ নৌকাটিতে থাকা প্রায় ২০০ রোহিঙ্গাকে কিছু খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করে বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।

প্রসঙ্গত ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর চালানো সহিংস অভিযানের পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসেন। বর্তমানে সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন কক্সবাজারে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।