রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে চায় চীন

জেসমিন পাপড়ি
2017.04.27
ঢাকা
কক্সবাজার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। কক্সবাজার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। জানুয়ারি ২৭, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে দুই দেশেরই অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ চীন। বাংলাদেশ সফরে এসে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকে এ প্রস্তাব দিয়েছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত সান গোসিয়াং।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের মনোভাব জানতেই গত সোমবার চার দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন চীনের বিশেষ দূত। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকা ছেড়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চললেও নীরব থেকেছে চীন। পাশাপাশি, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে কোনো ধরনের নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণেও বাধা দিয়েছে দেশটি।

রয়টার্সের সূত্র মতে, গত ১৭ মার্চ শুক্রবার নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১৫ সদস্য দেশ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক নিপীড়নের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়ার কথা থাকলেও রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে এতে বাঁধা দেয় চীন। তাতে বিবৃতিটি আটকে যায়।

এই প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স গত বুধবার জানায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকে চীনের বিশেষ দূত জানিয়েছেন, প্রয়োজনে (রোহিঙ্গা ইস্যুতে) তারা যেকোনো সাহায্য করতে রাজি আছে। স্পর্শকাতর হওয়ায় ওই কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি বলে জানায় সংবাদ সংস্থাটি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চীনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এই সমস্যা সমাধানে বারবার আহ্বান সত্ত্বেও মিয়ানমার আশানুরূপ সাড়া দেয়নি।

তবে ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাস রোহিঙ্গা ইস্যুতে গণমাধ্যমে কখনো কোনো মন্তব্য করে না।

চীনের বিশেষ দূত বাংলাদেশ সফরে এসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান, “চীনের উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। গত অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক অভিযান শুরুর পর থেকে বারবার আলোচনার জন্য মিয়ানমারকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দেশটির পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বিষয়টি আমরা চীনের দূতকে জানিয়েছি।”

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীনের এ উদ্যোগকে প্রশংসনীয় বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “চীন সরকারের এই সহযোগিতার মনোভাবকে যদি আমরা ব্যবহার করতে পারি, তাতে চাপে পড়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে পারে মিয়ানমার।”

তাঁর মতে, “সত্যিকার অর্থে চীন চাইলে এ সমস্যা সমাধান করতে পারবে। কারণ, চীনের ওপর মিয়ানমার অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকেই বাংলাদেশ ব্যবহার করতে পারে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহ. রুহুল আমিন বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের অসংখ্য উদ্বাস্তু মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে থাকলেও আন্তর্জাতিক সমাজ বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ সুযোগটা নিতে চাইছে চীন। এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বিরাজেও রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান হওয়া জরুরি।”

“মিয়ানমার চীনের সঙ্গে এখন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তাই রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের জন্য চীনই দেশটিকে রাজি করাতে পারবে বলে মনে হয়,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা চার লাখ

এদিকে বাংলাদেশ জানিয়েছে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংখ্যা চার লাখ তিন হাজারের কিছু বেশি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচআইসির ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন দ্য প্রোটেকশন অব দ্য রাইটস অব অল মায়েগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অ্যান্ড মেম্বারস অব দেয়ার ফ্যামিলিস (আইসিআরএমডব্লিউ) শুনানিতে রোহিঙ্গাদের এই হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ।

গত ৩-৪ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।

ইউএনএইচআইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৯৭৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মানবিক কারণে বাংলাদেশ দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেয়। ১৯৯১ সালে দুই দেশের চুক্তির আওতায় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জনকে ফেরত নেয় মিয়ানমার। হঠাৎ করেই ২০০৫ সালে এ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় দেশটি।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলেও ২০০৫ সালের পর থেকে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ-মিয়ানমার স্থল ও সমুদ্র সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হলে আরও প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

তবে নতুন করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন মিয়ানমারে ফেরত গেছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সভাপতি দুদু মিয়া।

“আরো ২০-৩০জন পুরোনো রোহিঙ্গাও এই সময়ে দেশে ফিরে গেছেন,” বেনারকে বলেন দুদু মিয়া।

নিজ দেশে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সীমান্তের তিনটি চেকপোস্টে অস্ত্রধারীদের হামলায় দেশটির নয়জন সীমান্তরক্ষী নিহত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের দমনে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হয়। এরপর থেকে প্রায় ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

বাংলাদেশে আশ্রয় পেলেও মানবেতর জীবনযাপন করছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। তাই নিরাপদভাবে নিজ দেশে ফিরতে আগ্রহী তাঁরা।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার মো. আয়াছ পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কক্সবাজারের লেদা ক্যাম্পে। তিনি বেনারকে বলেন, “গত ৮ মাস ধরে লেদা বস্তিতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছি। কোনো কাজ কর্ম নেই, কী করে করে বাঁচব? এখানে শুধু চাউল দিচ্ছে। তা দিয়ে কি মানুষের জীবন চলে। শুধু চিন্তা করি, কখন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারব।”

একই ক্যাম্পের দিলদার বেগম (৩০) বেনারকে বলেন, “ছোট্ট একটি ঘরে কারাগারের মতো গাদাগাদি করে ১০ জন থাকি। বৃষ্টি পড়লে সেখানেও আর থাকা যায় না। মাঝে মাঝে মনে হয়, মিয়ানমার সেনাদের হাতে মরে গেলে ভালোই হতো। এ যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। পরিস্থিতি ভালো হলে সন্তানদের নিয়ে ওপারে (মিয়ানমার) ফিরে যেতে চাই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।