সমুদ্রে ডাকাতির কবলে পড়া মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের পাঠানো হলো ভাসানচর

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2021.04.28
ঢাকা ও কক্সবাজার
সমুদ্রে ডাকাতির কবলে পড়া মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের পাঠানো হলো ভাসানচর টেকনাফে পুলিশ সদস্যদের সাথে সমুদ্র থেকে উদ্ধার হওয়া মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গারা। ২৭ এপ্রিল ২০২১।
[বেনারনিউজ]

সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া রওয়ানা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ডাকাতির কবলে পড়া ৩০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধারের পর বুধবার ভাসানচরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। 

টেকনাফ উপকূল থেকে মঙ্গলবার উদ্ধার করা রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছেন ২০ জন নারী এবং পাঁচজন করে শিশু ও পুরুষ। 

“নৌ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বুধবার দুপুরে তারা ভাসানচরে পৌঁছেছে,” বেনারকে জানান কোস্ট গার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমিরুল হক। 

উদ্ধারকৃত শরণার্থীদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, “রোহিঙ্গাদের বহনকারী ট্রলারটি মালয়েশিয়াগামী বড়ো জাহাজের অপেক্ষায় পাঁচদিন সাগরে ভাসমান থাকার পর ডাকাতের কবলে পড়ে। অর্থ ও মালামাল লুটের পর ডাকাতরা ট্রলারের ইঞ্জিনটি নষ্ট করে দিয়ে যায়।”

এর দুই দিন পর ট্রলারটি “ভাসতে ভাসতে টেকনাফের বাহারছড়ার বড়োডেইল পাড়া সৈকতের কাছাকাছি আসলে তাঁদের উদ্ধার করা হয়,” জানান ওই কর্মকর্তা। 

বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন বেনারকে জানান, তাঁর এলাকা থেকেই ট্রলারসহ ৩০ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। 

“উদ্ধারকৃতদের সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা,” বেনারকে জানান টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান। 

উদ্ধার করা রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারে নিজ নিজ শিবিরে ফিরিয়ে না নিয়ে ভাসানচরে পাঠানো “ভুল সিদ্ধান্ত” উল্লেখ করে অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “এখানে স্বচ্ছতারও অভাব রয়েছে।” 

“এটা কিছুটা শাস্তির মতো, যার মানে হচ্ছে তুমি অবৈধভাবে যাওয়ার চেষ্টা করেছ, এটা ঠিক হয়নি। তাই এখন শাস্তি হিসেবে তোমাকে ভাসানচরে পাঠিয়ে দিচ্ছি,” বলেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক এই কর্মকর্তা। 

তাঁর মতে, “মানবিক কারণেই তারা যেখান থেকে গিয়েছে সেখানেই ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। অবৈধভাবে যাত্রার জন্য তাদের বোঝানো যেতে পারে। কিন্তু তাদের কোনো শাস্তি পাওয়া উচিত না।” 

এমন একটি সময়ে এই ৩০ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হলো যার মাত্র একদিন আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, নোয়াখালীর ওই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটি ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আটক করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় মারধরের পাশাপাশি ‘ক্রসফায়ারে হত্যার’ হুমকি দিয়ে তাঁদের স্বজনদের কাছে ঘুষ দাবি করা হয়েছে। 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি মঙ্গলবার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত এ বিষয়ক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, “এসব অভিযোগের তদন্ত হওয়া উচিত।” 

এইচআরডব্লিউ-র অভিযোগ সত্য নয় 

এইচআরডব্লিউ-এর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহে আলম বুধবার বেনারকে জানান, সেখানে শরণার্থীদের মারধর বা ঘুষ চাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। 

বেনারকে একই তথ্য দিয়েছেন ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমোডোর রাশেদ সাত্তার এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াত। 

কোন প্রমাণের ভিত্তিতে এইচআরডব্লিউ এই অভিযোগ তুলেছে?-এমন প্রশ্নও তুলেছেন বাংলাদেশের এই কর্মকর্তারা। 

ভাসানচর থানায় শরণার্থী নির্যাতনের এক প্রত্যক্ষদর্শী এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছেন, মারধরের সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলছিলেন, “আপনারা অন্যান্য রোহিঙ্গাদের বলেন যে, তারা যদি পালানোর কথা চিন্তা করে তবে তাদের ভাগ্য একই হবে।” 

নোয়াখালীর ওই দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় গত ৬ এপ্রিল ধরা পড়া কমপক্ষে ১২ শরণার্থীকে গ্রেপ্তারের পর মারধরের কথা উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ বলেছে, “কর্তৃপক্ষ তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের অবহিত করেনি।” 

তবে ওসির দাবি, “পালানোর চেষ্টার জন্য নয়, একটি চুরির ঘটনায় ১২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে তারা নোয়াখালী কারাগারে রয়েছে।” 

তবে এর আগে ভাসানচর ছেড়ে পালানোর চেষ্টাকালে নয় জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ভাসানচরেই ছেড়ে দেয়া হয় বলে গত ৪ এপ্রিল বেনারকে জানিয়েছিলেন ভাসানচরের ওসি মাহে আলম। 

ওই নয় রোহিঙ্গা ছিলেন গত বছরের মে মাসে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা ৩০৬ জনের দলের। 

ক্রসফায়ারের হুমকি 

আটক হওয়া এক শরণার্থীর মায়ের বরাতে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করার হুমকি দিয়ে তাঁর কাছে ঘুষ দাবির কথা উল্লেখ করেছে এইচআরডব্লিউ। সেই মা তাদের বলেছেন, “একজন পুলিশ অফিসার আমাকে ডেকেছিলেন। কিন্তু আমি তার ভাষা বুঝতে না পারায় আমার যে ভাতিজি বাংলা বলতে পারে সে পুলিশ সদস্যের সাথে কথা বলেছিল।” 

“তিনি আমাদের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে, আমাদের নগদ অর্থ তৈরি রাখা উচিত, নয়তো তারা আমার ছেলেকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেবে। আমরা বলেছিলাম যে টাকা দিতে পারব না এবং জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার ছেলেটি এখন কোথায়? লোকটি বলল, আগে টাকা দাও, তবেই তোমার ছেলে নিরাপদে থাকবে,” এইচআরডব্লিউকে জানান তিনি। 

কমোডোর রাশেদ সাত্তার বলেন, “এখান থেকে কিছু রোহিঙ্গা পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়েছে এটা ঠিক। কিন্তু তাদের থানায় নিয়ে মারধর করা বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়েছে, এগুলো তারা (এইচআরডব্লিউ) কোথা থেকে জেনেছে? তাদের কী কোনো প্রমাণ আছে, নাকি শুধুই মৌখিক কথার উপরই তারা এমন অভিযোগ করছে?” 

এইচআরডব্লিউর অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে আরআরআরসি বলেন, “ভাসানচরের অবস্থা নিয়ে তারা যে পরিমাণ সোচ্চার, তার কিছু অংশও যদি মিয়ানমারের রাখাইনের ব্যাপারে হতো, তবে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত তৈরির ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যেত।” 

তবে আসিফ মুনীরের মতে, “ভাসানচরে সবকিছু নিখুঁত আছে এমন নয়। যারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে সেখানকার নানা খবর পেয়ে থাকে। আগেও এমন অভিযোগ শোনা গেছে।” 

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে আইনপ্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করার পাশাপাশি আট থেকে ১১ বছর বয়সী চার শিশুকে মারধরের অভিযোগও আনা হয়েছে। যদিও কর্মকর্তারা বলছেন এসব অভিযোগ মনগড়া। 

ভাসানচর ছাড়ার চেষ্টা করছে যারা 

কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের মে মাসে মালয়েশিয়াগামী যে ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সাগর থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যেই পালানোর প্রবণতা বেশি। কারণ তাঁদের অনেক আত্মীয়-স্বজন মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে রয়েছে। তাঁরাও সেখানে যেতে চান। 

“তাঁরা তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত, অবস্থাসম্পন্ন, একইসঙ্গে খুবই উচ্চাভিলাষী,” বলেন কমোডোর রাশেদ। 

ওই ৩০৬ রোহিঙ্গাকে এখনো বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি জানিয়ে আরআরআরসি বলেন, “তাদের উদ্ধার করেছিল নৌ বাহিনী। তারাই তাদের দেখাশোনা করছে। পরে যে সব রোহিঙ্গা সেখানে গেছে তাঁদের দেখভাল করছে বেসামরিক প্রশাসন।” 

ঈদের পরে এই ৩০৬ জনের ব্যাপারে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। 

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়েই ভাসানচরে ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে এই ৩০৬ রোহিঙ্গার ব্যাপারে বলা হয়েছে, সমুদ্র থেকে উদ্ধারের পর কোভিড সংক্রমণ ঠেকানোর কথা বলে তাঁদের সঙ্গনিরোধের জন্য ভাসানচরে নিয়ে গিয়ে এক বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে। 

এদিকে ভাসানচরে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম নামে এক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা বুধবার ফোনে বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে আসার পর প্রথম প্রথম খুবই ভালো ছিলাম আমরা। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। আমাদের চলাচলের উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।