সেবাকর্মীদের জন্য সহজ হলো রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশ

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2020.04.30
ঢাকা ও কক্সবাজার
200430_Humanitarian_Access-Bangla_1000.jpg বিশ্বখাদ্য সংস্থার সহযোগিতায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে উখিয়ার জামতলি রোহিঙ্গা শিবিরের একটি প্রবেশমুখে যানবাহন চেক করছেন আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। ৩০ এপ্রিল ২০২০।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে রোহিঙ্গা শিবিরে সেবাদানকারীর সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার ফলে শরণার্থীরা খাদ্য ও পানি সংকটের মুখোমুখি—মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এমন সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পে সেবাদানকারীদের প্রবেশ সহজ করতে বৃহস্পতিবার চালু হলো ডিজিটাল যানবাহন প্রবেশ ব্যবস্থা।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ ও লজিস্টিক সেক্টরের সহয়তায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে যানবাহন প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করল সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়।

বেনারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর উখিয়া ও টেকনাফের ঘিঞ্জি রোহিঙ্গা শিবিরে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার।

এতে শিবিরে ৮০ শতাংশ কর্মকর্তার প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে জানিয়ে এর ফলে অনেক রোহিঙ্গা শিবিরে খাবার, পানি, ওষুধসহ চিকিৎসা সেবার সংকট হতে পারে বলে গত সোমবার আশঙ্কা প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ প্রত্যাখান করে শরণার্থী কামিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বেনারকে বলেন, ক্যাম্পে খাবার বা পানি নেই এই অভিযোগ সত্য নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন ৫৬৪ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে সারা দেশে এই ভাইরাসে মোট আক্রান্ত ৭ হাজার ৬৬৭ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘন্টায় মৃত ৫ জনসহ সব মিলিয়ে এই রোগে দেশে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৮৮ জন।

তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো রোহিঙ্গা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ৩১ হাজারের বেশি।

সময় বাঁচবে, সেবার মান বাড়বে

বৃহস্পতিবার বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে শিবিরে প্রবেশ করতে কর্মকর্তাদের গাড়িতে বসে দুই ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো।

কারণ সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে আলাদাভাবে তল্লাশি করে তবেই প্রবেশ করতে দিতেন।

নতুন ব্যবস্থা চালুর পর কোনো রকম শারিরীক তল্লাশির প্রয়োজন হবে না।

“আগে ক্যাম্পে প্রবেশ করতে প্রতিটি গাড়ি আলাদাভাবে চেক করা হতো। সে কারণে সময় বেশি লাগত,” মন্তব্য করে সামছু-দ্দৌজা বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এখন ক্যাম্পে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং জাতিসংঘ সংস্থার কর্মকর্তারা সহজে কোনো প্রকার শারিরীক তল্লাশি ছাড়া ক্যাম্পে প্রবেশ করতে পারছেন।”

“ফলে রোহিঙ্গারা আরও ভালো সেবা পাবেন,” বলেন তিনি।

রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটির সভাপতি মো. সিরাজুল মোস্তফা বেনারকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সেবাদানকারীর সংখ্যা কমে গেছে। বর্তমানে শুধু অতি জরুরি সেবাগুলো চালু রাখা হয়েছে।

উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নুর বেনারকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার এই উদ্যোগ রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী সবার জন্য ইতিবাচক।

তিনি বলেন, “আমরা মনে করি মানবিক সেবা প্রদানকারী লোকজন যত বেশি ক্যাম্পে কাজ করতে পারবে রোহিঙ্গারা তত বেশি সেবা পাবে।”

মালয়েশিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাই

গত ১৬ এপ্রিল মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী কয়েকশ রোহিঙ্গা শরণার্থী বোঝাই একটি ট্রলারকে তাদের তীরে ভিড়তে দেয়নি।

দেশের সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রচলিত আইন অনুযায়ীই ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানান দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জয়নুদ্দিন।

“তবে রোহিঙ্গাদের নৌকাকে মালয়েশিয়ার জলসীমা থেকে বহিস্কারের আগে মানবিক দিক বিবেচনায় তাঁদেরকে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে,” বিবৃতিতে বলেন তিনি।

বিদেশিদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে দেশের সীমান্ত বন্ধ করা সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকেই রোহিঙ্গাদের তীরে ভিড়তে দেয়া হয়নি বলেও উল্লেখ করেন মালয়েশিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সাগরে ভাসা রোহিঙ্গাদের গ্রহণে রাজি নয় বাংলাদেশ

এদিকে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় না পেয়ে বাংলাদেশের কাছাকাছি ফিরে আসা আনুমানিক পাঁচশ রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ ও শিশু গত কয়েদিন ধরে গভীর সমুদ্রে ভাসছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহবান উপেক্ষা করে তাঁদের বহনকারী মাছধরা ট্রলার দুটিকে তীরে ভিড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে বাংলাদেশ।

তবে ওই নৌকা দুটি বর্তমানে বাংলাদেশের জলসীমায় নেই বলে বৃহস্পতিবার মন্তব্য করেছেন পরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।

নেদারল্যান্ডসের বৈদেশিক বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা মন্ত্রী সিগ্রিড কাগ এর সাথে টেলিফোন আলাপের সময় তিনি এই মন্তব্য করেন বলে জানায় রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস।

বাসস জানায়, ডাচ মন্ত্রীকে ড. মোমেন বলেন, “পাঁচশ রোহিঙ্গা বহনকারী মাছধরা ট্রলার দুটি বাংলাদেশের জলসীমায় বা তার ধারেকাছেও নেই।”

“আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশেরও ওই রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর দায়িত্ব রয়েছে,” মন্তব্য করেন তিনি।

ডাচ মন্ত্রীর সাথে বুধবারের এই ফোনালাপের কথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বৃহস্পতিবার বেনারনিউজকে নিশ্চিত করেছেন।

তাঁরা দাবি, মিয়ানমার থেকে স্থল সীমান্ত দিয়ে আসতে না পেরেই সমুদ্র পথে আসার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা।

তিনি বেনারকে বলেন, “তাঁকে (ডাচ মন্ত্রী) বলেছি, আমাদের লোকেরা এখন সীমান্ত পাহারা দেয়, যাতে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করতে না পারে।”

আরও রোহিঙ্গাকে সমুদ্রে ঠেলে দিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে উৎসাহ দিতে চায় না বলেও বেনারের কাছে মন্তব্য করেন পরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের চট্রগ্রাম-পূর্ব জোনের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বিএন) এম সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সমুদ্রে আমাদের টহল অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।”

এর আগে মঙ্গলবার কক্সবাজার থেকে ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র লুইস ডোনোভান বেনারকে বলেছিলেন, “আমরা ওই নৌকাগুলোর বর্তমান অবস্থান বা তাঁদের যাত্রা শুরুর জায়গাটি নিশ্চিত করতে পারছি না।”

তবে ওই নৌকা দুটির মধ্যে গত ১৬ এপ্রিল মালয়েশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া নৌকা রয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বাংলাদেশকে সহায়তায় কনসর্টিয়াম

করোনাভাইরাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য কনসর্টিয়াম গঠন করেছে ছয়টি আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান: প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন, কেয়ার বাংলাদেশ, অক্সফাম, ওয়ার্ল্ডভিশন এবং কারিতাস বাংলাদেশ।

রোহিঙ্গা ছাড়াও বাংলাদেশের চার লাখ ৪৪ হাজার স্থানীয় জনগণসহ মোট ১৩ লাখ মানুষকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করতে এই ছয় সংগঠন কাজ করবে বলে সংস্থাগুলোর পক্ষে এক বিবৃতিতে জানানো হয় বৃহস্পতিবার।

এতে বলা হয়েছে, সংস্থাগুলোর তিন বছরের কনসোর্টিয়াম প্রোগ্রামে বরাদ্দ করা অস্ট্রেলিয়া সরকারের ৪৪ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে এই কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি, কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান এবং কুয়ালালামপুর থেকে হাদি আজমি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।