নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশ, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে পাঠানো হলো ভাসানচরে

জেসমিন পাপড়ি
2020.05.03
ঢাকা
200503-bd-ROHINGYA-FINAL1000.jpg বাংলাদেশ উপকূলের কাছে নিরাপত্তারক্ষীদের তল্লাশির মুখে একটি রোহিঙ্গা নৌকা। ২ মে ২০২০।
[এএফপি]

হঠাৎ করে সাগরপথে কক্সবাজারের টেকনাফে এসে পৌঁছানো একদল রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর দ্বীপ ভাসানচরে পাঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভাসানচরে পাঠানো এটিই প্রথম রোহিঙ্গা দল।

কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের চাপ কমাতে এক লাখ শরণার্থীর জন্য বঙ্গোপসাগরে নতুন জেগে ওঠা ভাসানচরকে প্রস্তুত করেছিল সরকার। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের বিরোধিতায় সে সিদ্ধান্ত পরে স্থগিত করা হয়।

নতুন করে আসা শরণার্থীদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শিবিরে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা থেকে এবার তাঁদেরকে কক্সবাজারে না পাঠিয়ে ভাসানচর পাঠানো হয়েছে বলে রোববার বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।

“যে রোহিঙ্গারা আসছে তারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত কি না কে জানে! সেজন্য আমরা এদেরকে দূরে ভাসানচরে পাঠিয়েছি। যাতে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের থেকে তাদের আলাদা করে রাখা যায়,” রোববার বেনারকে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “হঠাৎ করে পরশু (শুক্রবার) রাতে ডিঙ্গি নৌকায় করে কিছু রোহিঙ্গা টেকনাফে ঢুকে পড়ে। এদের কয়েকজন পালিয়ে যায়, বাকিদের শনিবার গভীর রাতে কোস্ট গার্ড ভাসানচরে দিয়ে এসেছে। সেখানে তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে।”

তিনি জানান, সরকারই আপাতত এদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবে। নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে সাগরে পাওয়া গেলে তাঁদেরকেও ভাসানচরে পাঠানো হবে।

ঠিক কতজনকে ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে সংখ্যা বলতে পারেননি। তবে কোস্টগার্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “উদ্ধার হওয়া ২৯ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ৫ জন শিশু, ১৯ জন নারী এবং ৫ জন পুরুষ।”

এদিকে ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা, ডাক্তার ও দশ সদস্যের একটি পুলিশ টিম ইতিমধ্যেই পাঠানো হয়েছে বলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রাহমান বেনারকে বলেন, “এটা সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। ধীরে ধীরে তাঁদের ভাসানচরে পুনর্বাসন করা ছাড়া বিকল্প নেই। কারণ, বাংলাদেশ এই ভার বহন করতে পারবে না।”

“ঘনবসতিতে থাকার ফলে রোহিঙ্গাদের কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এছাড়া রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। তাই তাঁদের ভাসানচরের পাঠানোর সিদ্ধান্ত উপযুক্ত বলে মনে করি।”

তবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানে না বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।

উল্লেখ্য, মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়া প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছালেও তাঁদের তীরে ভিড়তে দেয়নি দেশটি। এরপর ভাসতে ভাসতে নৌকা দুটি ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তাঁদের গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ। ফলে আবারও গভীর সমুদ্রে ফিরে যেতে বাধ্য হয় ট্রলার দুটি।

এদিকে এসব অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। তবে বাংলাদেশ বারবার জানায়, ট্রলার দুটি এদেশের জলসীমায় নেই। এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো অন্তত তাঁদের দায়িত্ব নিক। এরই মাঝে একদল রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করল।

তবে শুক্রবার বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের এই দলটি সাগরে ভাসা কথিত ৫০০ রোহিঙ্গার অংশ কি না তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে রোববার বাংলাদেশে নতুন করে ৬৬৫ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে দেশে এ ভাইরাসটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল নয় হাজার ৪৫৫ জনে। এছাড়া আরো দুজনের মৃত্যুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৭ জনে। এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হননি।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, রোববার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ লাখ ৯৪ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ৪৬ হাজারের বেশি।

জানে না ইউএনএইচসিআর

শুরু থেকে ভাসানচরের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসা ইউএনএইচসিআর বলছে, একদল রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানোর সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কিছু জানে না।

ইউএনএইচসিআর ঢাকা অফিসের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “গণমাধ্যমের দেখার পরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘ বলে আসছে ভাসানচরে স্থানান্তরের আগে সুরক্ষা ও স্থায়ীত্বের বিষয়ে প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন জরুরি। জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।”

সমুদ্রপথে আরো রোহিঙ্গা আসার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র বলেন, এদের অনেকেরই পরিবার, বন্ধুবান্ধব কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে রয়েছেন। কোয়ারেন্টিনের সময় শেষে এসব রোহিঙ্গারা নিজেদের কমিউনিটিতে ফিরতে পারবে। যা তাদেরকে এই দুর্দশাজনক এবং ভয়ঙ্কর ভ্রমণের ট্রমা থেকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে।”

কভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষিতে নৌকায় করে আসা যেকোনো শরণার্থীকে কোয়ারেন্টিনে রাখার সব ধরনের প্রস্তুতি ইউএনএইচসিআরের রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সাজ্জাদ বলেন, “পনেরো দিন আগে সাগরে থেকে উদ্ধার করা প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গা ১৪ দিনের নির্দিষ্ট কোয়ারেন্টিন শেষ করেছে। তাদের মধ্যে কারো কভিড-১৯ সংক্রমণের কোনও লক্ষণ না থাকায় রোহিঙ্গা শিবিরে ফিরে গেছেন তাঁরা।”

ফলে প্রয়োজনে আরো শরণার্থীকে কোয়ারেন্টিনে রাখার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে বলে জানায় ইউএনএইচসিআর।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন টেকনাফ থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।