সাগরে ভাসা আরও ২৭৯ রোহিঙ্গা যাচ্ছে ভাসানচর
2020.05.07
ঢাকা
বঙ্গোপসাগরে ভাসতে থাকা পৌনে তিনশর বেশি রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ভাসানচরে পাঠানো হচ্ছে। নারী ও শিশুসহ ওই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে তৈরি একটি ট্রলারে গাদাগাদি করে সেন্ট মার্টিনের কাছে ভাসছিলেন।
বুধবার দিবাগত রাত একটার দিকে ২৭৯ জন রোহিঙ্গা বোঝাই ওই ট্রলারটি সেন্ট মার্টিন থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল বলে বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে জানান বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার পরিচালক কমডোর আফজালুল হক।
তিনি বলেন, “তারা একটি ট্রলারে গাদাগাদি করে অবস্থান করছিল। আমরা তাদের উদ্ধার করেছি।”
“ট্রলারটি এখন চট্টগ্রামের কাছাকাছি আছে। সেটি ভাসানচরে পাঠানো হচ্ছে,” বলেন আফজালুল হক।
এদিকে এখন থেকে আর কোনো রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় দেওয়া হবে না বলে বেনারকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান।
“ইতোমধ্যে ২৯ জন রোহিঙ্গাকে সাগর থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে পাঠিয়ে দিয়েছি,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্ত হলো, যেসকল রোহিঙ্গাকে সাগরে পাওয়া যাবে তাদের সবাইকে ভাসানচরে পাঠানো হবে।”
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে দেশটির উত্তর রাখাইন প্রদেশ থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেন। সরকারি হিসাবে বর্তমানে সেখানে কমপক্ষে ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলাধীন ভাসানচরে একলাখ রোহিঙ্গার বাসস্থান নির্মাণ করে সরকার। কিন্তু দফায় দফায় চেষ্টা হলেও জাতিসংঘসহ মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণে সেখানে কোনো রোহিঙ্গাকে পাঠানো সম্ভব হয়নি।
তবে ভাসানচরে পাঠানো রোহিঙ্গার সংখ্যা ২৯ নয় বরং ২৮ বলে বেনারকে জানান হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, “আসলে ২৯ নয়, ২৮ জন রোহিঙ্গাকে সাগর থেকে উদ্ধার ভাসানচরে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী তাঁদের উদ্ধার করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে।”
ওই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নবাগত শরণার্থীদের মাধ্যমে শিবিরগুলোতে করোনাভাইরাস সক্রমণের আশঙ্কা থেকেই তাঁদেরকে দূরবর্তী ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে।
তবে ভাসানচরে পাঠানো কারো মধ্যেই করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে রেজাউল করিম বলেন, “তারা সবাই ভালো আছে।”
ওই রোহিঙ্গারা সকলেই কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে থেকে মানবপাচারকারীদের প্ররোচনায় মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে মালয়েশিয়া শরণার্থীদের গ্রহণ না করে সমুদ্রে তাড়িয়ে দেয়, ফলে তাঁরা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসার চেষ্টা করেন।
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুযায়ী ওই ২৮ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে গিয়েছিল,” বলেন রেজাউল করিম।
‘একজন রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দেবে না বাংলাদেশ’
সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেশ কিছু রোহিঙ্গার সাগরে ভেসে থাকার খবর পাওয়ার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানালে প্রথমে বাংলাদেশ অস্বীকৃতি জানায়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন আর একজন রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দেবে না বাংলাদেশ।
“আমি এখনও বলি আমরা একজন বাড়তি রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দেবো না,” মন্তব্য করে বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেন, “কিন্তু মানবিক কারণে তাদের কয়েকজনকে ভাসানচরে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তারা সাগরে দিনের পর দিন ভাসছিল। সর্বোপরি তারা মানুষ। আমরা অতটা অমানুষ হতে পারি না।”
মন্ত্রী বলেন, “আমরা মানবিক কারণে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। প্রায় তিনবছর হতে চলল, মিয়ানমার তাদের গ্রহণ করছে না। আর রোহিঙ্গারাও যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “রাখাইনে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। কিন্তু কেউ জোরালোভাবে কথা বলছে না। তারা কেউ মিয়ানমারে পরিবেশ উন্নতির কথা বলছে না যাতে রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরে যেতে পারে।”
মন্ত্রী বলেন, রাখাইনে চলমান যুদ্ধের কারণে সেখানকার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ফলে, রাখাইনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এই সমস্যার একটি সমাধান প্রয়োজন।
এদিকে নারী ও শিশুসহ ভাসানচরে পাঠানো রোহিঙ্গা দলটি সম্পর্কে অবহিত আছেন জানিয়ে ইউএনএইচসিআর’র কমুনিকেশন অফিসার লুইস ডোনোভান বেনারকে বলেন, “সাগরে যে ৩৫০ রোহিঙ্গা ভেসে বেড়াচ্ছে, ভাসানচরে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা তাদের সাথে ছিল।”
“বাকিরা এখনও সাগরে আটকা পড়ে আছে,” বলেন ডোনোভান।
বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কোথাও নিজেদের ভবিষ্যত দেখতে না পাওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা মরিয়া হয়ে মালয়েশিয়া যেতে চায় বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা নেতা মো. আফজাল।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা জানে, মিয়ানমার অথবা বাংলাদেশ কোথাও তাদের ভবিষ্যত নেই। সেকারণে তারা যেভাবে পারছে বের হয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছে।”
“তারা জানে, সাগরে মারা যেতে পারে,” বলেন আফজাল।
সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আশ্রয় দেয়াকে মানবিক বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন।
তিনি বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হলো, তারা মানুষ। তাদের নিজ দেশে অনিরাপদ পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কাজেই তারা বাংলাদেশে অথবা অন্য কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে, চেষ্টা করছে।”
আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিতে রাজি হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক হলো, চীন, রাশিয়া, জাপানসহ বিশ্বের সকল বড় বড় শক্তি মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে।”
তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে সাগরপথে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন।