সাক্ষাৎকার: রাখাইন রাজ্যে নতুন করে জাতিগত সহিংসতার আশঙ্কা করছেন রোহিঙ্গা নেতা
2024.05.07

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বার্মিজ রোহিঙ্গা সংস্থার সভাপতি তুন খিন রোহিঙ্গা অধিকারের জন্য একজন নেতৃস্থানীয় প্রচারক। তাঁর মতে, পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী এবং জাতিগত আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলমান সংঘর্ষে রোহিঙ্গারা যুদ্ধাপরাধের শিকার হচ্ছেন।
উভয় পক্ষই সেখানে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের যুদ্ধে নিয়োগ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অন্যদিকে সামরিক জান্তা পরিকল্পিতভাবে জাতিগত রাখাইন এবং রোহিঙ্গা জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। দীর্ঘ দিন থেকে তারা জাতিগত সহিংসতার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে সামরিক দমন অভিযানে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন।
বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) সাথে এক সাক্ষাৎকারে তুন খিন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি তাঁর জনগণের বিরুদ্ধে আরো সহিংসতা বাড়াতে পারে। তিনি সেনাবাহিনীর অভিযোগেরও জবাব দেন। সম্প্রতি জান্তা সরকার অভিযোগ করেছে, তিনি আরাকান আর্মি (এএ)’র জন্য ৫০,০০০ সৈন্য নিয়োগের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট করার জন্য সম্পাদনা করা হয়েছে।
আরএফএ: গত মাসে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে আপনার দলের বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাই। মিয়ানমারের জান্তা দাবি করেছে, আপনার সফরের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এএ’র জন্য নিয়োগ করা। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
তুন খিন: আমরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করতে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। গণহত্যা থেকে পালিয়ে প্রায় সাত বছর ধরে তারা সেখানে আশ্রিত হয়ে আছে। আমাদের সফরের আরেকটি কারণ ছিল বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দেখা করা। আমরা শিশুদের স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি (মিয়ানমারে) প্রত্যাবাসন কর্মসূচি সম্পর্কেও আলোচনা করেছি। আমাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে- এটা আমাদের অধিকার।
কিন্তু জান্তার মুখপাত্র জাও মিন তুন ভুল তথ্য দিয়েছেন। আমরা এএ’র সাথে দেখা করিনি বা তাদের জন্য সৈন্য নিয়োগ করিনি। প্রকৃতপক্ষে আমরা শুধু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কীভাবে জীবন কাটাচ্ছে তার খোঁজ খবর নিয়েছি এবং তাদের জন্য আরও সহায়তা পেতে কাজ করেছি।

আরএফএ: মিয়ানমারে সশস্ত্র যুদ্ধ প্রবল হওয়ায় রোহিঙ্গাদের সামরিক চাকরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
তুন খিন: বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। আমার ভয়, পরিস্থিতি ২০১৭ সালের চেয়ে আরও খারাপ হবে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে [যখন এএ সামরিক বাহিনীর সাথে তাদের যুদ্ধবিরতি অবসান ঘটায়], রোহিঙ্গা জনগণ এএ এবং জান্তা সৈন্যদের মধ্যে আটকা পড়েছে। মিনবিয়া এবং অন্যান্য এলাকায় বিমান হামলায় অনেক রোহিঙ্গা মারা গেছে।
বিশেষ করে বুথিডং শহরে ‘হপন নিয়ো লেইক’ গ্রামের নিয়ন্ত্রণ এএ নেওয়ার পর জান্তা সৈন্যরা গ্রামটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়, যদিও গ্রামটি ‘অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের আশ্রয়কেন্দ্র’ (আইডিপি) হিসেবে স্বীকৃত ছিল। সম্প্রতি, রোহিঙ্গাদের সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তের শরণার্থী শিবির থেকে কমপক্ষে ৫০০ জনকে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়েছে। বুথিডং এবং মংডু শহরেও প্রায় ৫০০ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে।
জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের দিয়ে এএ’র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, জান্তা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে কাজ করছে। সে বিষয়ে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
ইতিমধ্যে, এএ অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের আটক করেছে … মংডু এবং বুথিডংয়ে নিরীহ বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করার অভিযোগ করছে এবং রোহিঙ্গা গ্রাম থেকে খাদ্য ও অন্যান্য জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করেছে। এটা অগ্রহণযোগ্য।
আমাদের কাছে এমনও রিপোর্ট রয়েছে যে এএ জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গেছে এবং সেনা চাকরি থেকে রেহাই দেওয়ার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছে। তাই সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে আমাদের রোহিঙ্গা জনগণ খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে।

আরএফএ: রাখাইন রাজ্যের শহরগুলো দখল করছে এএ। যদি এএ পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ পায়, তাহলে রোহিঙ্গাদের কী হবে?
তুন খিন: সামরিক বাহিনী আমাদের সবার সাধারণ শত্রু। তারা ২০১৭ সালে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ৩৯০টিরও বেশি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর কাছ থেকে আমরা সব ধরনের বর্বরতা সহ্য করেছি। সুতরাং, সামরিক বাহিনীকে অপসারণ করতে কাজ করছে এমন যে কোনো গ্রুপের সাথে আমরা একত্রে আছি।
অন্যদিকে, এএ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সাথে লড়তে গিয়ে রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ করছে, যারা ইতিমধ্যেই গণহত্যার শিকার হচ্ছে। তাদের এটা বন্ধ করা দরকার। আমরা ঘৃণা ছড়াতে দেখছি। আমরা রোহিঙ্গারা শান্তিতে একসাথে থাকতে চাই।
আরএফএ: এএ নেতারা ‘রোহিঙ্গা’ কথাটা ব্যবহার করেন না এবং পরিবর্তে ‘বাঙালি’ ব্যবহার করেন, [যা দিয়ে তারা বোঝাতে চান, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে]। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
তুন খিন: আমরা বাঙালি নই। আমরা রাখাইন রাজ্যের একটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। আমরা রোহিঙ্গা, এবং আমরা রোহিঙ্গা হিসেবে অভিহিত হওয়াই আশা করি। আমাদের নিজস্ব রীতিনীতি ও সংস্কৃতি আছে।
আমরা আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একটি মানবগোষ্ঠী। আমরা... রাখাইন রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। এএ’র এটিকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা’র চর্চা করা উচিত।
আরএফএ: সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র দিচ্ছে। আপনি কি মনে করেন রোহিঙ্গারা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম?
তুন খিন: সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের অস্ত্র দিচ্ছে, কিন্তু মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। … সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে রোহিঙ্গারা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না।