আর্জেন্টিনায় রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা সম্পর্কে জাতিসংঘের প্রাক্তন মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদকের সাক্ষাৎকার

আরএফএ বার্মিজ
2024.05.08
আর্জেন্টিনায় রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা সম্পর্কে জাতিসংঘের প্রাক্তন মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদকের সাক্ষাৎকার জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর একটি সংবাদ সম্মেলনে উত্তর কোরিয়ায় মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক টমাস ওজেয়া ক্যাইন্টানা। ৯ মার্চ ২০২০।
[এএফপি]

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী টমাস ওজেয়া ক্যাইন্টানা সম্প্রতি বেনারনিউজের সহযোগী সংবাদ সংস্থা রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) সাংবাদিক ইয়ে কাউং মিন্ট মং-এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন।

সাক্ষাৎকারে তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে আর্জেন্টিনার আদালতে মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে দায়েরকৃত মামলা সম্পর্কে কথা বলেছেন।

আর্জেন্টিনার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ‘সর্বজনীন বিচারব্যবস্থা’ নীতির আওতায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। ওই বিধান অনুযায়ী কিছু অপরাধ এত জঘন্য যে হাজার হাজার মাইল দূরে অভিযুক্ত অপরাধীদেরও বিচার করা যেতে পারে।

রাখাইনে ২০১২ এবং ২০১৮ সালে সংঘটিত সহিংসতাকে কেন্দ্র করে ৪৬ পৃষ্ঠার তথ্য সম্বলিত ওই ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। সেই সহিংসতায় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগ আজ অবধি প্রতিবেশী বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন।

মামলার নথিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং তাঁদের বেসামরিক সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ, শিরচ্ছেদ ও হত্যার বর্ণনা রয়েছে। এতে মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘ-সমর্থিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন ২০১৭-২০১৯ কর্তৃক সংগৃহীত বিশদ তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মিশন মিয়ানমার ও বাংলাদেশে অবস্থানরত শত শত প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল।

ক্যাইন্টানা ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক (special rapporteur) হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসেবে উত্তর কোরিয়ায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একই ধরনের দায়িত্ব পালন করেছেন।

সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য করার জন্য সম্পাদনা করা হয়েছে।

আরএফএ: মিস্টার ক্যাইন্টানা, আরএফএ’র পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা। মামলার কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসার মাধ্যমে আমি সাক্ষাৎকার শুরু করতে চাই? মামলাটি কতদূর এগিয়েছে?

ক্যাইন্টানা: আমি বলব, মামলাটি এগোচ্ছে। আর্জেন্টিনার প্রসিকিউটর গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পেশ করছেন। আদালত সেনা অভিযান থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষ্যদর্শীর সাক্ষ্য নিয়েছে। তাঁরা বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন।

আসলে তাঁরা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যার অংশ হিসেবে আর্জেন্টিনার আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। একই সময়ে আর্জেন্টিনার আদালত মিয়ানমার থেকে আসা প্রকৃত ভিকটিমদের সাথে যোগাযোগ করছিল। সার্বজনীন এখতিয়ারের মামলার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভুক্তভোগীরা এখন আদালতে তঁদের কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। …এখন আমরা আদালতের তদন্ত পর্যায়ে আছি, এবং আমরা বিশ্বাস করি আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে একটি সারগর্ভ সিদ্ধান্ত নেবে।

আরএফএ: মামলাটির সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য কোনো সময়সূচি জানাতে পারবেন?

ক্যাইন্টানা: এই মামলার অন্যতম বাদী বার্মিজ রোহিঙ্গা সংস্থা ইউকে গত বছরের ডিসেম্বরে আদালতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জমা দেয়। এখন সেটি আদালতে বিবেচনাধীন রয়েছে। আমরা আশা করছি এ বছরের মধ্যে কোনো এক সময়ে আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।

আরএফএ: অভিযুক্ত অপরাধীদের বিষয়ে আপনি আমাদের কী বলতে পারেন?

ক্যাইন্টানা: ফাইলটি গোপনীয়। আমি এতটুকু বলতে পারি যে বার্মিজ রোহিঙ্গা সংস্থা ইউকে আবেদনে সাতজন অপরাধীর একটি তালিকা অন্তর্ভুক্ত করেছে। যার মধ্যে শীর্ষ সামরিক কর্তা থেকে শুরু করে দু’জন সাধারণ ব্যক্তি আছেন যারা নৃশংসতায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। এতটুকুই আপনাকে বলতে পারি।

আমরা আশা করি এ বছরের মধ্যে আদালত এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেবে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ন্যায়বিচার প্রত্যাশার ভিত্তি রচনার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ হবে। এটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে জবাবদিহিতার বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও হবে।

এটি সামগ্রিক বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ এমন ন্যাক্কারজনক আন্তর্জাতিক অপরাধের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

pic 2.jpeg
টোকিওতে মিয়ানমারের দূতাবাসের বাইরে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে একটি সমাবেশের সময় জাপানে বসবাসকারী মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং-এর ছবিযুক্ত পোস্টার পা দিয়ে মাড়াচ্ছেন। পোস্টারে গণহত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত জান্তার ছবিতে “একে ধরিয়ে দিন” বার্তা রয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। [রয়টার্স]

আরএফএ: আমরা দেখছি, ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থার অবনতি হয়েছে। আপনার মামলার কিছু উদ্বাস্তু সাক্ষী কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে এসেছেন। ওই ক্যাম্পে মহিলাদের অবস্থার কি উন্নতি হয়েছে?

ক্যাইন্টানা: হ্যাঁ, তবে এ বিষয়টি আর্জেন্টিনার মামলার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। আদালত মূলত ২০১৭ সালের আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার তদন্ত করছে।

তবে আদালত সাক্ষীদের সুরক্ষা পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দেয়, এবং আর্জেন্টিনার আদালত এদিকে লক্ষ রাখছে। কক্সবাজারে ফিরে আসা সাক্ষীরা পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও ক্যাম্পের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ঠিক আছেন কিনা আদালত তা দেখার চেষ্টা করছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো এই শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস করছেন, যেখানে, আপনি জানেন, বসবাসের সুযোগসুবিধা পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে আরও মনোযোগ দিতে হবে।

আরএফএ: আপাতত অন্যান্য আন্তর্জাতিক সমস্যার কারণে বিশ্বের মনোযোগ মিয়ানমার থেকে অনেক দূরে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মনোযোগ ফেরাতে কী দরকার?

ক্যাইন্টানা: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, তবে তা প্রতিক্রিয়ার বাড়তি কিছু।

সত্য হলো, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। আমরা আশা করি আর্জেন্টিনার এই মামলাটি গণহত্যার পুনরাবৃত্তি ঘটার পরিস্থিতি তৈরি না করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বাড়াতে অবদান রাখবে।

pic 3.jpeg
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের তৃতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে ব্যাংককে জাতিসংঘের অফিসের বাইরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের সময় কারাবন্দি বেসামরিক নেতা অং সান সু চির একটি ছবির পাশে দাঁড়িয়ে নকল রক্তে রঞ্জিত একজন প্রতিবাদকারী তিন আঙুলের স্যালুট দিচ্ছেন। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪। [এএফপি]

আরএফএ: আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা মামলার আরও আইনি প্রক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সার্বজনীন এখতিয়ারের অধীনে একটি মামলা দায়ের করা এবং উপযুক্ত শাস্তি পাওয়া অত্যন্ত বিরল। চিলির প্রেসিডেন্ট আউগুস্তো পিনোচেটের বিরুদ্ধে মামলাটি দেখুন। এ মামলা থেকে আমরা কতটা আশা করতে পারি?

ক্যাইন্টানা: সারা বিশ্বে ন্যায়বিচারের স্বার্থে পিনোচেটের মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্পেনের সর্বজনীন বিচারব্যবস্থার মামলার ভিত্তিতে তাঁকে লন্ডনে আটক করা হয়েছিল। তাঁর একনায়কত্বের শিকার চিলির জনগণের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অস্ত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও গুরুত্বপূর্ণ। যারা আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমরা তাঁদের সকলের কাছে যাব – যেমন আসিয়ান, জাতিসংঘ; এবং অবশ্যই দ্য হেগে চলমান আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মামলাটিও।

এসব মামলা সর্বজনীন ধারণা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, তা হলো গণহত্যা যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন, আমাদের গণহত্যাকে মেনে নেওয়া উচিত নয়। সুতরাং যদি আর্জেন্টিনার আদালত এই ওয়ারেন্ট জারি করে, আমরা মিডিয়াসহ সকলের কাছে যাব; যাতে সবাই জানতে পারে অপরাধীরা, যারা অপরাধ করেছে, তাঁদের আদালতে তলব করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।