অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা, তিন পাচারকারীসহ ২৪ রোহিঙ্গা আটক

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2021.05.11
ঢাকা ও কক্সবাজার
অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা, তিন পাচারকারীসহ ২৪ রোহিঙ্গা আটক টেকনাফ থানায় একজন পুলিশ সদস্যের (ডানে দাঁড়ানো) সাথে মানবপাচারকারী চক্রের কবল থেকে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের একাংশ। ১১ মে ২০২১।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

আপডেট: ১২ মে ২০২১। ইস্টার্ন সময় সকাল ১০:৪৫

কক্সবাজারে মানব পাচারকারীদের কবল থেকে দুই দিনে ২৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য তাঁদের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে নিয়ে টেকনাফের দুটি বাড়িতে জড়ো করা হয়েছিল। 

সোমবার দুপুরে ও মঙ্গলবার ভোরের দিকে পৃথক দুটি অভিযান চালানোর কথা উল্লেখ করে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বেনারকে জানান, উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১৪ জন নারী ও পাঁচজন শিশু রয়েছে।

“এ ছাড়া পাচার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দুই নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ,” বলেন তিনি।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী, সোমবার বিকেলে টেকনাফের শামলাপুর ইউনিয়নের বড়ডেইল জাহাজপুরা গ্রামের নুরুল আমিনের বাড়ি থেকে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য জড়ো করা চার রোহিঙ্গা নারী ও দুই শিশুকে উদ্ধার করা হয়।

রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পরে নুরুল আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান ওসি। 

একইদিন উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের জালিয়াঘাটা গ্রামের রফিকুল ইসলামের বাড়ি থেকে মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে নিয়ে আসা ১০ জন রোহিঙ্গা নারী, পাঁচ পুরুষ ও তিন শিশুকে উদ্ধার করা হয়। 

রফিকুল পালাতে সমর্থ হলেও তাঁর স্ত্রী রশিদা বেগম ও মেয়ে রাজিয়া বেগমকে (২০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

“গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে নগদ এক লাখ ১০ হাজার টাকাসহ স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়েছে, যা মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নিয়েছিল,” বেনারকে বলেন ওসি। 

উদ্ধার হওয়া ২৪ জন রোহিঙ্গা ও গ্রেপ্তার তিন জনকে মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজারের আদালতে হাজির করা হলে বিচারক উদ্ধারকৃতদের নিজ নিজ ক্যাম্প প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর এবং গ্রেপ্তারকৃতদের জেলা কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। 

ওই রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছয়জন টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের, পাঁচজন উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের এবং ১৩ জন অন্যান্য ক্যাম্পের বাসিন্দা বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

‘কেউ চলে গেলে আর জানা যায় না’

জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারে সক্রিয় এন্টি-ট্রাফিকিং ওয়ার্কিং গ্রুপ (এটিডব্লিউজি) চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৪৩ জন রোহিঙ্গাকে শিবির থেকে পাচারের চেষ্টা চিহ্নিত করেছে।

এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্তদের কেউ উদ্ধার করেনি। তারা নিজেরাই পাচারকারীদের কাছ থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছে বলে ১২ এপ্রিল তৈরি করা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এটিডব্লিউজি, যা চলতি মাসে জাতিসংঘের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

এদিকে উল্লেখিত ২৪ জনসহ গত দুই সপ্তাহে মোট ৫৪ জনকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

প্রসঙ্গত, শরণার্থী শিবির ছেড়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া ৩০ রোহিঙ্গাকে গত ২৭ এপ্রিল টেকনাফ উপকূল থেকে উদ্ধারের পর ভাসানচরে পাঠিয়ে দেয় কোস্ট গার্ড, যাদের মধ্যে ২০ জন নারী এবং পাঁচজন করে শিশু ও পুরুষ।

তবে এই পরিস্থিতিতেও “পাচার বেড়েছে না ধরা পড়া বেড়েছে সেটা নিশ্চিত হওয়া কঠিন,” উল্লেখ করে অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “কেউ চলে গেলে সেটা কিন্তু আর জানা যায় না।” 

“সাধারণত শীতকালে সমুদ্র শান্ত থাকার সময়টাতেই নৌপথে পাচার বেশি হয়। তবে এমনও হতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র উত্তাল থাকার কারণে আমাদের জলসীমার নজরদারি শিথিল হওয়ায় পাচারকারীদের সক্রিয়তা হয়ত বেড়ে গেছে,” যোগ করেন তিনি।

আইওএম-এর এই সাবেক কর্মকর্তার মতে, “কোভিড পরিস্থিতির কারণে শিবিরগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কমে যাওয়ারও সুযোগ নিতে পারে পাচারকারী চক্রের স্থানীয় সদস্যরা।”

আবহাওয়ার কারণে সমুদ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে টেকনাফের ওসি বলেন, “সক্রিয় দালালদের ধরতে এখন থেকে নিয়মিত অভিযান চালাবে পুলিশ।”

“রোহিঙ্গাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন মালয়েশিয়ায় রয়েছে। তাদের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েই স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করছে তারা,” যোগ করেন ওসি।

এর সত্যতা নিশ্চিত করে টেকনাফের লেদার নতুন শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোস্তফা কামাল বেনারকে বলেন, “মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী অনেক রোহিঙ্গা যুবককে মোবাইলে বিয়ে করে এভাবে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে ক্যাম্পের অনেক নারী।”

“তা ছাড়া পুরুষ রোহিঙ্গারাও এখানে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। বেকারত্ব দূর করতে তারাও সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে,” যোগ করেন তিনি। 

এটিডব্লিউজির দাবি, ২০২০ সালে আনুমানিক দুই হাজার চারশো রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশি অভিবাসী নৌকায় গাদাগাদি করে আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পৌঁছেছে।

“এই বিপজ্জনক যাত্রায় কমপক্ষে দুইশো জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে,” যোগ করেছে ওই গ্রুপটি।

সংশোধনী: ভুলবশত মূল প্রতিবেদনে চার পাচারকারী গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছিল। ভুলটি সংশোধন করা হলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।