রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাফেরায় ব্যাপক কড়াকড়ি
2022.05.12
কক্সবাজার ও ঢাকা
সম্প্রতি ঈদের ছুটিতে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা শরণার্থী পুলিশের হাতে আটকের পর শিবিরগুলোতে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। অভিযোগ উঠেছে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যেতেও পাস নিতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা ও শরণার্থী বেনারকে নিশ্চিত করেছেন যে, ঈদের সময়ের ঘটনার পর পুলিশ তাঁদের অবাধে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যেতে দিচ্ছে না এবং অন্তত দুটি ক্যাম্পে ‘ক্যাম্প টু ক্যাম্প মুভমেন্ট পাস’ নামে একটি নতুন পাস চালু করা হয়েছে।
এই পাসের দুটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে। এগুলোতে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিজস্ব ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যেতে হলে ক্যাম্প ইনচার্জ, ক্যাম্প প্রধান মাঝি (কমিউনিটি নেতা) এবং ব্লক প্রধান মাঝির (কমিউনিটি নেতা) অনুমতি নিতে হবে।
দুটি পাসের মধ্যে একটি ১৫ নম্বর ক্যাম্প থেকে ইস্যু করা হয়েছে। এই ক্যাম্পের প্রধান মাঝি মোঃ হাবিব বেনারকে বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্পের বাহিরে আসা-যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় কর্মকর্তাদের নির্দেশে পাসটি চালু হয়েছে।
“সম্প্রতি আমি আমার ক্যাম্পের একজন মহিলার জন্য একটি পাসের ব্যবস্থা করেছি। ওই মহিলার একজন আত্মীয় অন্য ক্যাম্পে মারা গেছে,” জানান হাবিব।
তবে কোন কর্মকর্তার নির্দেশে এই পাস চালু হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করে এই বিষয়ে তাঁকে আর কোনো প্রশ্ন না করারও অনুরোধ করেন তিনি।
মুহাম্মদ ইসলাম নামে একজন রোহিঙ্গা নেতা বেনারকে বলেন, “কয়েকদিন আগে আমি অন্য ক্যাম্পে আমার বোনকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছি ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে। আমার বোন খুব অসুস্থ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাকে এখনও অনুমতি দেয়নি।”
১৫ নম্বর ক্যাম্প আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ (এপিবিএন) এর অধীনে।
এপিবিএন-৮ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা এ ধরনের পাস ইস্যু করিনি। এটা অন্য কর্তৃপক্ষের কাজ হতে পারে।”
বেনারের হাতে থাকা পাসটিতে দেয়া স্বাক্ষর সম্পর্কে জানতে চেয়ে ক্যাম্প-১৫ এর ইনচার্জ শংকর কুমার বিশ্বাসকে ফোন করা হলে, এই বিষয়টি নিয়ে তিনি পরে ফোন করে কথা বলবেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন। তবে পরবর্তীতে তিনি আর ফোন করেননি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বেনারকে বলেন বলেন, “আমরা নতুন পাসের বিষয়ে অবগত নই। তবে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে চাইলে তাঁদের পাস প্রয়োজন হয়।”
ঈদের পর থেকে কড়াকড়ি
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী বেনারকে বলেন, ঈদ-উল-ফিতরের ছুটির পর ক্যাম্পের ভেতর চলাচলে তাঁরা আরও কঠিন নিয়মকানুনের সম্মুখীন হচ্ছেন।
গত ৪ ও ৫ মে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও এপিবিএনের অভিযানে মোট ৬৫৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। তাঁরা ঈদের উৎসবে সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলেন।
কক্সবাজার পুলিশ জানিয়েছে, আটক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি এবং তাঁদের নিজ নিজ ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া বিভাগের গবেষক শায়না বাউচনার এইচআরডব্লিউ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে দাবি করেছেন যে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ক্যাম্প এলাকায় চলাচলের জন্য একটি কঠোর অনুমতির আবেদন চালু করেছে, যা কিছু শরণার্থীদের জন্য নিপীড়নমূলক।
এই নিবন্ধে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের এ ধরনের কঠোর নিয়মকানুনের মুখোমুখি হয়েছিল।
এতে আরো বলা হয়, “কর্তৃপক্ষ পুরো ক্যাম্প জুড়ে এই নীতি চালু করার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে।”
নিবন্ধে আরও বলা হয়, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পাঁচজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে কথা বলেছে, যারা গত কয়েকদিনে ক্যাম্প চেকপয়েন্টে এপিবিএন অফিসার এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের দ্বারা মারধরের অভিযোগ করেছেন।”
“আমরা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ক্যাম্পে বাস করি, উদযাপনের কোনো উপায় নেই, তাই আমরা ঈদ উদযাপন করতে [একটি কাছাকাছি সমুদ্র সৈকতে] গিয়েছিলাম,” নিবন্ধে একজন নাম প্রকাশ না করা রোহিঙ্গা শরণার্থীর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
ওই ব্যক্তি আরও বলেন: “…আমাদের আটকে রাখে, এবং তারপর ক্যাম্পে ফেরত পরিবহনের জন্য আমাদের প্রতিজনের কাছ থেকে দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা নেয়।”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কামরান হোসেন বলেন, এসব অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। অনেক মহল এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ায় কারণ তারা ক্যাম্পগুলোকে অস্থিতিশীল দেখতে চায়।
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপ-জেলায় ৩৪টি শরণার্থী শিবির রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে (ইউএনএইচসিআর) একটি ইমেইল পাঠিয়ে এই বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
ভারত থেকে আসা ১৮ রোহিঙ্গা আটক
ভারত থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের অভিযোগে বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজার জেলায় চারটি রোহিঙ্গা পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ, এদের দশজনই শিশু।
মৌলভীবাজার সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রবিউল হক জানান, রোহিঙ্গাদের এই চারটি পরিবার ভারতের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করত এবং একটি পরিবার অপর পরিবারকে চিনতো না।
তিনি বলেন, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলার কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে বৃহস্পতিবার ভোর দুইটার দিকে (স্থানীয় সময়) এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
"পাচারকারীরা তাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে এবং সীমান্তে এসেই পরিবারগুলো একত্রিত হয়েছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন তাঁরা,” যোগ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আনুমানিক ১৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থী বসবাস করছেন।
ইউএনএইচসিআরের মতে বাংলাদেশে প্রায় নয় লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন, যাকে জাতিসংঘ কর্তৃক জাতিগত নির্মূল এবং সম্ভাব্য গণহত্যা বলে অভিহিত করা হয়।