‘আরসার আস্তানা’ থেকে অস্ত্র-বিস্ফোরক উদ্ধার, দুজন আটক
2024.05.15
কক্সবাজার ও ঢাকা
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরের কাছে একটি দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আরাফাত ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, আস্তানাটি ছিল মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা)।
অভিযানের সময় আরসার কমান্ডারসহ দুজনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। আটকরা হচ্ছেন উখিয়ার ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. শাহনুর ওরফে মাস্টার সলিম (৩৮) ও বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. রিয়াজ (৩৫)।
র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উখিয়ার হাকিমপাড়া ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে দুর্গম লাল পাহাড়ে “আরসা সন্ত্রাসীদের” অবস্থানের খবর পেয়ে র্যাবের বিশেষ একটি দল সেখানে বুধবার ভোররাতে অভিযান শুরু করে। সে সময় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে র্যাবের “বন্দুকযুদ্ধ” হয়।
আরসার আস্তানা থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি গ্রেনেড, তিনটি রাইফেল গ্রেনেড, ১০টি দেশীয় হ্যান্ড গ্রেনেড, ১৩টি ককটেল, একটি বিদেশি রিভলভার, একটি এলজি, বিপুল পরিমাণ বারুদ ও কার্তুজ।
পরে সেনাবাহিনীর বোম ডিসপোজাল ইউনিট বিস্ফোরকগুলো নিষ্ক্রিয় করে।
র্যাবের দাবি, আটক সলিম আরসার প্রধান
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১৫ কক্সবাজার কার্যালয়ের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, অভিযানে আটক মাস্টার সলিম বাংলাদেশে আরসার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ক্যাম্পগুলোতে আবারও আরসার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে।
আরসার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে অস্ত্র-বিস্ফোরক সংগ্রহ করে তারা রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাস সৃষ্টি করছে।
র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মাস্টার সলিম ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে বালুখালী ক্যাম্প-১৫তে বসবাস শুরু করেন।
এর আগে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির দেহরক্ষী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
“সম্প্রতি বাংলাদেশে আরসা নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ায় মাস্টার সলিমকে আরসার প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সলিমের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যাসহ একাধিক মামলা ও রিয়াজের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা রয়েছে,” বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
সংবাদ সম্মেলনে আরাফাত বলেন, “র্যাবের অভিযানে আরসা নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়েছিল। এছাড়া, অস্ত্র উদ্ধার করায় তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পার্শ্ববর্তী দেশে (মিয়ানমার) সংঘাতের মধ্যে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট এবং অস্ত্রাগার লুটের খবর আমরা পেয়েছি, আরসা এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছে।”
কীভাবে এই অস্ত্রগুলো তাদের হাতে এলো এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তা অধিকতর তদন্তে বের হয়ে আসবে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংঘর্ষ চলছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে মে মাসে ১৭ খুন
রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের ৩২টি ক্যাম্পে দলগত সশস্ত্র তৎপরতা, মাদক, মানবপাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল থেকে শুরু করে তুচ্ছ ঘটনায় ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র।
তাঁরা জানান, ক্যাম্পে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা বিস্তারে দেশীয় নানা অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও র্যাবের তথ্যমতে, চলতি মে মাসের প্রথমার্ধেই ক্যাম্পগুলোতে চার কমিউনিটি নেতাসহ ১৭ জন রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছেন।
সর্বশেষ গত ১৪ মে সোমবার উখিয়া একটি শিবিরের হেড মাঝি মোহাম্মদ ইলিয়াসকে (৪৩) ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে আরসার বিরুদ্ধে।
এর আগে ৬ মে উখিয়ার বালুখালী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা জাফর আহমদকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ধারণা করা হচ্ছে, সেই হত্যাকাণ্ডেও আরসা জড়িত। তার আগের দিন বালুখালীর রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) সদস্য নুর কামালকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর হিসাবে শরণার্থী শিবিরে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ঘটনায় ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালের ১৪ মে পর্যন্ত গত সাড়ে পাঁচ মাসে ১৬ জন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে খুন হয়েছেন।
র্যাব জানায়, এসব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আরসার শীর্ষ নেতাসহ ১১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ক্যাম্পে আতঙ্ক, সীমান্তে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ
রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ সেলিম বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে আগের তুলনায় সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়েছে, ফলে হত্যাকাণ্ডও বেড়েছে। মূলত আরসার সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে যেসব রোহিঙ্গারা সক্রিয়, তাদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে।”
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর কামাল বেনারকে বলেন, “দিন দিন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশে আশ্রয় শিবিরগুলোতেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। মিয়ানমারে ফেরার পথও বন্ধ হয়ে আছে।”
বুধবার বিকেলেও কক্সবাজারের টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা সীমান্তের ওপারে মর্টার শেল ও বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
টেকনাফ পৌর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসলাম বেনারকে বলেন, “সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিকট শব্দ ভেসে আসছে। আজকেও (বুধবার) থেমে থেমে শব্দ পাওয়া গেছে।”
সীমান্ত এলাকায় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদস্যরাও সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ ব্যাটালিয়নের (বিজিবি-২) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ।
তিনি বেনারকে বলেন, “নতুন করে সীমান্ত দিয়ে যাতে কোনো অনুপ্রবেশের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য আমাদের টহল জোরদার আছে।”