রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়া পেছাল

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.05.25
ঢাকা
উখিয়ার মধুরছড়া তীরে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শিবির। উখিয়ার মধুরছড়া তীরে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শিবির। ২২ মে ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের জনবহুল শরণার্থী শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার নতুন সময় ঠিক করেছে সরকার। পরিবর্তিত সময় অনুযায়ী আগস্ট-সেপ্টেম্বেরের দিকে তাঁদের সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মহসিন।

এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মো. মহসিনের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি কারিগ​রি কমিটি গঠন করেছে সরকার। এতে সরকারের ছয়জন ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাসহ (ইউএনএইচসিআর) অন্যান্য সংস্থার পাঁচজন প্রতিনিধি রয়েছেন।

মো. মহসিন বেনারকে বলেন, “আগে জুনের মধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে তাঁদের নেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা রাখি।”

গত বছর নভেম্বরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। এ জন্য ২৩০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ হয়।

মো. মহসিন বলেন, ভাসানচরে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে দিনরাত দ্রুততার সঙ্গে কাজ চলছে।

“আমাদের কাছে আসা প্রতিবেদন অনুযায়ী ভাসানচরের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে,” জানিয়ে মহসিন বলেন, “আগামী সপ্তাহে আমরা কমিটির সভা করে ভাসানচর পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত নেব। পরিদর্শনের পর আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করব, কবে নাগাদ তাঁদের সেখানে নেওয়া সম্ভব হবে।”

শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য পরিকল্পনা মাফিক ঘরবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে তারা ভালোভাবে থাকতে পারবে। তবে তিনি বলেন, সরকার কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ভাসানচরে পাঠাবে না।

এদিকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

বালুখালী শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গা নেতা মাহমুদ বেনারকে বলেন, “আমরা তো জানি না সেই জায়গা কেমন। সেখানে কী আছে আমরা তাও জানি না। তবে বসবাস উপযোগী হলে আপত্তি নেই। আমরা এখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আছি। জাতিসংঘ যা বলবে আমরা সেটাই করব।”

গত বছর ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি নামক জঙ্গি সংগঠন মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একযোগে হামলা চালালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী উত্তর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়। প্রাণ ভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় পালিয়ে আসে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বন জঙ্গল কেটে আশ্রয় দেওয়া হয় তাঁদের।

রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছর ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।

রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সময়সাপেক্ষ হবে মাথায় রেখে সরকার তাঁদের ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পাশাপাশি তাঁদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকার ও দাতা সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে।

মানবিক সংকট মোকাবেলায় শিক্ষণীয় উদাহরণ

এ বছর জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত এশিয়ান ডিজাসটার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সমীক্ষা অনুসারে কক্সবাজারের উখিয়ার শরণার্থী শিবিরের নেড়া পাহাড়ে বসবাসরত কয়েক লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ শরণার্থী সরাসরি ভূমিধসের শিকার হবেন বলে আশঙ্কা করে ইউএনএইচসিআর এবং জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)।

সেই প্রতিবেদন পরীক্ষা করে সম্ভাব্য ধস ও বন্যার ঝুঁকিতে থাকা ২৫ হাজার রোহিঙ্গা চিহ্নিত করেছে সরকার।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা সেলের প্রধান হাবিবুল কবির চৌধুরী শুক্রবার বেনারকে বলেন “চিহ্নিত ওই ২৫ হাজার রোহিঙ্গাসহ আরও পাঁচ হাজার মানুষকে কুতুপালং-বালুখালী শিবিরের পাশের সমতল স্থানে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আরও কয়েক হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।”

এদিকে যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে অসংখ্য রোহিঙ্গা ভূমিধসের আশঙ্কায় রয়েছেন বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল।

এতে বলা হয়, রোহিঙ্গারা ভূমিধসের শিকার হলে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আদায় করা বাংলাদেশের ‘সব সুনাম ভেসে যাবে’।

এই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ‘শরণার্থী মর্যাদা’ না দেওয়া, স্থিতিশীল আবাসন তৈরি না করাসহ তাঁদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অভাব ও শরণার্থীদের সহায়তায় আগ্রহী সংস্থাগুলোকে অনুমতি দেবার ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করা হয়।

এছাড়া ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতারও অভিযোগ করা হয় এতে।

এই প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে “আমরা রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের এই পর্যবেক্ষণের সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত করি,” বলে মন্তব্য করেন হাবিবুল কবির চৌধুরী।

তিনি বলেন, “আমরা মাঠ পর্যায়ে কী দানবীয় কর্মযজ্ঞ করে যাচ্ছি সে সম্পর্কে বিন্দু মাত্র না জেনে এই মন্তব্যগুলো করা হয়েছে।”

“সমগ্র ইউরোপ যেখানে এক বছরে এক লাখ শরণার্থী সামলাতে পারেনি, সেখানে আমরা মাত্র তিনমাসে দশ লাখ শরণার্থী সামলেছি। অনেকেই বলেছিলেন যে অসুখে কিংবা অপুষ্টিতে হাজারো মানুষ মারা যাবে, কিন্তু তা ঘটেনি। ক্ষুধায় কিংবা অসুখে একজন শরণার্থীও মারা যায়নি,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “মানবিক সংকট কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় তা আমাদের কাছ থেকে বিশ্বের শেখা উচিত। আমরা মৌসুমী বর্ষা, বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগের সাথেই বসবাস করি; আমরা জানি এগুলো কীভাবে মোকাবেলা করতে হয়।”

“ইতিমধ্যেই আমরা দুর্যোগের হুমকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি,” যোগ করেন হাবিবুল কবির চৌধুরী।

রোহিঙ্গাদের সতর্ক করতে কর্মসূচি

শুক্রবার প্রকাশিত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে সাইক্লোনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অজির্ত জ্ঞান এবার শরণার্থী শিবিরে প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এর অংশ হিসেবে সরকার ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় ৪৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মানুষ বন্যা ও পাহাড়ধসের ঝুঁকির পাশাপাশি ঘুর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।

কুতুপালং ও নয়াপাড়া ক্যাম্পে দায়িত্বরত সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঘুর্ণিঝড়সহ অন্যান্য মোকাবিলার প্রস্তুতি বাংলাদেশে বেশ পুরানো। এবার রোহিঙ্গাদের জন্য এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

তিনি জানান, সরকারের এই সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে সহায়তা করছে ইউএনএইচসিআর, ইউএন রিফিউজি এজেন্সিসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা।

“ঝড়ের সময় মানুষ কী করবে তা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” জানান প্রশিক্ষণ নেওয়া ৩৫ বছর বয়সী নারী স্বেচ্ছাসেবক জামালিদা। তিনি বলেন, “ঝড় আসার আগে সতর্কবার্তা শুনলে বা লাল পতাকা দেখলে কী করতে হবে, তা আগত রোহিঙ্গাদের অনেকেই হয়তো জানে না। আমরা তাঁদের সেটা জানাব, বোঝাব।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।