বান্দরবানে বিজিবি’র গুলিতে ‘চোরাকারবারি’ নিহত
2024.06.03
ঢাকা ও কক্সবাজার
মিয়ানমার সীমান্তে পরিচালিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অভিযানে এক ‘চোরাকারবারি’ নিহত হয়েছেন। এর ঠিক চার দিন আগে, চোরাচালান বিরোধী কার্যক্রম আরও জোরদার করতে মতামত দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
সোমবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে নিহত ওই ব্যক্তির নাম নিজাম উদ্দিন, যিনি স্থানীয়ভাবে ‘নিজাম ডাকাত’ নামে পরিচিত ছিলেন। কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন তিনি।
সোমবার দুপুরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রকিবুজ্জামান। তিনি বলেন, “আমরা নেজাম উদ্দিন নামে এক ব্যাক্তির লাশ উদ্ধার করেছি। ”
এদিকে সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিজিবি জানিয়েছে, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বিজিবি’র মাদক ও চোরাচালনবিরোধী টহল দলের ওপর “নিজাম ডাকাত চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের গুলিবর্ষণ ও বিজিবি’র মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আত্মরক্ষার্থে” গুলি চালায় বিজিবি সদস্যরা। এসময় উদ্ধার করা হয়েছে ইয়াবা ও বার্মিজ সিগারেট।
তবে নিহত নিজামের পিতা বশির আহমদ স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, “আমার ছেলে পরশুদিন নাইক্ষ্যংছড়ি বেড়াতে যায়। পরে শুনলাম বিজিবি’র সাথে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছে। আজ তার লাশ এসেছে।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমদ বেনারকে বলেন, “সীমান্তে চোরাচালানবিরোধী অপারেশন জোরদার করা হয়েছে। বিজিবি’র প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন রয়েছে। চোরাচালান বন্ধ করতেই হবে।”
যাচ্ছে সার-জ্বালানি তেল, আসছে অস্ত্র, মাদক
সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান সম্পর্কে গত ২৯ মে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় প্রতিবেদন পেশ করে বিজিবি।
বেনারের হাতে আসা ওই প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ থেকে সার, জ্বালানি ও ভোজ্য তেল, ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, তৈরি পোশাক, বৈদেশিক মূদ্রা, স্বর্ণ, কষ্টিপাথর ও মাছ চোরাচালানের মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতে পাঠানো হয়।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচারকালে বিজিবি সদস্যরা ২৬৮ কোটি টাকার বেশি পণ্য আটক করেছে।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, মিয়ারমার ও ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে ইয়াবা ট্যাবলেট ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আসছে। মিয়ানমার থেকে ক্রিস্টাল মেথ আইসের মতো বিপজ্জনক মাদক বাংলাদেশে আনা হচ্ছে।
এছাড়া দুই দেশ থেকে বিভিন্ন অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক ও জালনোট বাংলাদেশে আসছে। ভারত থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণে আসছে ভারতীয় শাড়ি।
বিজিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট পাঁচ হাজার ৪১২ কোটি টাকার বেশি পণ্য আটক করেছেন বিজিবি সদস্যরা।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে দিয়ে কত টাকার চোরাচালান হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বলা যায় বিজিবি সারাবছর যে পরিমাণ পণ্য আটক করে, চালান হয়ে যাওয়া প্রকৃত পণ্যের পরিমাণ তার কমপক্ষে ১০ গুণ। ”
তার মতে, যেসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমারে চলে যাচ্ছে সেগুলোর বেশ কয়েকটি সরকারের নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে বন্ধ করা সম্ভব। যেমন রাসায়নিক সারের দাম বাংলাদেশে কম; ভর্তূকি দিয়ে এর দাম বাংলাদেশের বাজারে কম রাখা হয়েছে। জ্বালানি তেলের দামের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
ড. আহসান মনসুর বলেন, “দুটি স্থানে কোন পণ্যের দামে বড় ফারাক থাকলে যেখানে দাম কম সেখানকার পণ্য যেখানে দাম বেশি সেখানে চলে যাবে। যদি এসব পণ্যের দাম সমান করা হয়, তাহলেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। তবে অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন প্রকার মাদক চোরাচালান বন্ধ করতে হবে এনফোর্সমেন্ট দিয়ে।”
তিনি বলেন, “চোরাচালানির সাথে বিজিবি’র কিছু সদস্যের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়, আবার অসত্যও বলা যায় না। দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বড় সমস্যা।”
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. সৈয়দ গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে মূল্যবান পণ্য মিয়ানমার ও ভারতে চলে যাচ্ছে, যেগুলো বৈদেশিক মূদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে যা ঢুকছে সেগুলো অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের স্বার্থে এই চোরাকারবারি বন্ধ করতে হবে।”
অরক্ষিত সীমান্ত
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার। মিয়ানমারের সাথে ২৭১ কিলোমিটার।
ভারতের সাথে মোট ৪৯ কিলোমিটার সীমান্ত অরক্ষিত, মিয়ানমারের সাথে অরক্ষিত সীমান্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ.কে.এম. শহিদুল হক বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের একটি বড় অংশে তারকাঁটার বেড়া নেই। সেখানে বিজিবি সদস্যদের যাওয়ার অবস্থা নেই, এই সুযোগ নেয় চোরাকারবারীরা।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সোমবার বেনারকে বলেন, “সীমান্তে বিজিবি চোরাকারবারিসহ অপরাধ দমনে নিয়োজিত আছে। মাদক, অস্ত্রসহ বিভিন্ন নিম্নমানের, ভেজাল পণ্যের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হবে না।”