আটক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানোর কথা ভাবছে মালয়েশিয়া
2020.06.09
কুয়ালালামপুর
সমুদ্রপথে অবৈধভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার ২৬৯ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা ভাবছে দেশটি। তবে বাংলাদেশ সরকারের মতে, রোহিঙ্গাদের নেওয়ার কোনো দায় বাংলাদেশের নেই।
মঙ্গলবার মালয়েশিয় কর্মকর্তারা জানান, ওই রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে গিয়েছিলেন কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যদি তা হয়ে থাকে, তবে তাঁদেরকে ফেরত নেবার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানাবে দেশটি।
“আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তাঁদেরকে আমাদের দেশে গ্রহণ করব না। আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলব বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করে দেখতে যে, সোমবারে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে এসেছেন কি না। যদি তা হয়ে থাকে, তবে আমরা তাঁদের ফেরত পাঠাব,” মঙ্গলবার কুয়ালালামপুরে সাংবাদিকদের বলেন মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব।
এছাড়া রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো যায় কি না সে বিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সাথে আলোচনার জন্যও নিজেদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হবে বলে জানান ইয়াকুব।
সোমবার ভোরে আন্তর্জাতিক সমুদ্র সীমা থেকে একটি ভাঙাচোরা নৌকায় করে ২৬৯ জন রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় কেদাহ রাজ্যের লঙকাওয়ি দ্বীপে ওঠার চেষ্টা করেন বলে এক বিবৃতিতে জানায় দেশটির ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্স (এনটিএফ)।
এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা নৌকার সংবাদ পেয়ে লঙকাওয়ি পুলিশের নৌশাখার কমান্ডার নৌকাটিকে মালয়েশিয়ার জলসীমা থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য দুটি জাহাজ পাঠান।
কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর জাহাজ দেখতে পেয়ে নৌকা থেকে লাফিয়ে নেমে ৫৩ জন রোহিঙ্গা তীরের দিকে সাঁতারাতে থাকেন। তাঁদেরকে গ্রেপ্তারের পর নৌকাটির কাছে গিয়ে কর্মকর্তারা দেখতে পান, রোহিঙ্গারা ইচ্ছাকৃতভাবে ছিদ্র করে নৌকাটিকে মেরামতের অযোগ্য করে রেখেছে।
ফলে তাঁদেরকে তাড়িয়ে দেবার জন্য আর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে কর্মকর্তারা নৌকার বাকি ২১৬ রোহিঙ্গাকেও গ্রেপ্তার করেন। এছাড়া নৌকা থেকে এক নারীর মরদেহও উদ্ধার করেন তাঁরা।
“মানবিক কারণে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল নৌকাটিকে লঙকাওয়ি নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়,” জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয় পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পর আটকদের অস্থায়ীভাবে লঙকাওয়ির ন্যাশনাল বিল্ডিং ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।
মালয়েশিয়া জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। ফলে দেশটি অনুপ্রবেশকারীদের শরণার্থীর মর্যাদা না দিয়ে অবৈধ অভিবাসী হিসেবেই গণ্য করে থাকে।
এদিকে নৌকা থেকে মৃতদেহ উদ্ধার নৌকাটির তীরে ভিড়তে না পেরে দীর্ঘদিন সমুদ্রে ভেসে থাকার প্রমাণ বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক প্রীতি ভরদ্বাজ বেনারকে বলেন, “এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার যে, নৌকাটিতে এক নারীর মরদেহ পাওয়া গেছে। এতে এটি পরিস্কার যে নিরাপদভাবে তীরে ভিড়তে না পেরে নৌকাটি সমুদ্রে ভাসছিল।”
মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের নৌকা ভিড়তে দেওয়ার জন্য মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি।
“দুর্গতদের বহনকারী নৌকাকে সব সময়ই নিরপদে তীরে ভিড়তে দেওয়া উচিত। কোনোভাবেই তাঁদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া, ভয় দেখানো বা নির্যাতন করা উচিত নয়,” বলেন প্রীতি ভরদ্বাজ।
এদিকে শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা মালয়েশিয়ান এক এনজিওর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বেনারকে জানান, ধারণা করা হচ্ছে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে থেকে দুটি নৌকা ৭০০ থেকে ৮০০ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
“এখনো অন্য নৌকাটি সমুদ্রে রয়ে গেছে। নৌকা দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল,” বলেন ওই এনজিও কর্মকর্তা।
অভিবাসীদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় সম্প্রতি স্থল ও জলসীমায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে মালয়েশিয়া।
এর আগে গত ৫ এপ্রিল লঙকাওয়ি দ্বীপে ২০২ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে একটি নৌকা পৌঁছেছিল। এরপর ১৬ এপ্রিল একটি নৌকা প্রায় ২০০ রোহিঙ্গাকে নিয়ে দেশটিতে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাঁদের কিছু মানবিক সহায়তা দিয়ে আবার আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাড়িয়ে দেয় মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী।
তবে ওই পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার দায়ে মালয়েশিয়ার কঠোর সমালোচনা করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
তার মাত্র একদিন আগে উপকূলীয় জলসীমা থেকে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ, যারা মালয়েশিয়ার তীরে ভিড়তে ব্যর্থ হয়ে প্রায় দুই মাস সমুদ্রে ভেসে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
মে মাসের প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়া ২২টি নৌকা ও ১৪০ জন অভিবাসীকে দেশটিতে অনুপ্রবেশে বাধা দিয়েছে বলে সোমবার জানান দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব।
সোমবার পুত্রজায়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে মোট ৩৯৬ জন অভিবাসী ও নৌকা থেকে পলাতক ১০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
রোহিঙ্গাদের নেবে না বাংলাদেশ
মালয়েশিয়ায় আটক রোহিঙ্গাদের ফেরত আনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অনুরোধ আসেনি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
তবে দেশটি থেকে এমন অনুরোধ এলে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা আমাদের নাগরিক নয়, তাঁদেরকে নেওয়ার কোনো দায়বদ্ধতা আমাদের নেই।”
“আমরা আর কোনো রোহিঙ্গা নেব না,” জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মালয়েশিয়া আসিয়ানের সদস্য দেশ উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, “মিয়ানমার তাদের আসিয়ান বন্ধু। আর রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাই মালয়েশিয়ার উচিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। অন্যথায় নিজের দেশে রাখুক।”
“পৃথিবীর যেকোনো স্থানে রোহিঙ্গাদের দেখা পেলেই যে তাদের বাংলাদেশে পাঠাতে হবে এই ধরনের মনমানসিকতার পরিবর্তন দরকার,” বলেন আবদুল মোমেন।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি ও কুয়ালালামপুর থেকে রে শেরমান।