থাই উপকূলে রোহিঙ্গাবাহী নৌকার খোঁজ পেয়েছে মালয়েশিয়া
2020.06.10
কুয়ালালামপুর ও ব্যাংকক
বেশ কয়েকবার মালয়েশিয়ার তীরে ভিড়তে ব্যর্থ হয়ে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা নিয়ে একটি নৌকা বর্তমানে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের কাছে সমুদ্রে ভাসছে বলে বুধবার জানিয়েছেন মালয়েশিয় কোস্ট গার্ডের কর্মকর্তারা।
নৌকাটি গত চার মাস ধরে সমুদ্রে রয়েছে বলে বেনারকে জানান দেশটির কোস্ট গার্ডের প্রধান মোহাম্মদ জুবিল ম্যাট সম। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের পাচারকারী চক্র ওই নৌকাটিতে খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ করছে বলে জানান তিনি।
“প্রায় ৩০০ মানুষ নিয়ে নৌকাটি এখন কোহ আদাং দ্বীপের কাছে রয়েছে। আমাদের ধারণা, এর আগে তীরে পৌছানো অন্য নৌকার সাথে এটিও গত ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজার থেকে যাত্রা করেছে,” বলেন মালয়েশিয় মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির (এমএমইএ) মহাপরিচালক মোহাম্মদ জুবিল।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২৬৯ জন রোহিঙ্গা নিয়ে সোমবার প্রথম নৌকাটি মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় কেদাহ রাজ্যের লঙকাওয়ি দ্বীপে পৌঁছায়।
দ্বিতীয় নৌকাটি মালয়েশিয়ার তীরে ভেড়ার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেছিল জানিয়ে মোহাম্মদ জুবিল বলেন, নিয়মিত তল্লাশি দলের বাধার কারণে এটি ব্যর্থ হয়ে সমুদ্রে ফিরে যায়।
এদিকে আন্দামান সাগরে মালয়েশিয়ার নিকটবর্তী থাই দ্বীপ কোহ আদাং এর আশেপাশে কোনো রোহিঙ্গা নৌকার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন থাইল্যান্ডের কর্মকর্তারা।
“জাহাজ ও হেলিকপ্টার দিয়ে তল্লাশি চালিয়েও আমরা কিছু পাইনি। আমরা এমন কাউকেই দেখিনি,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন থাই নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা।
তিনি জানান, ২০১৯ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা নৌকাকে থাই জলসীমায় দেখা যায়নি।
এদিকে অবৈধ অভিবাসীদের কোনো নৌকাকেই আর মালয়েশিয়ায় ভিড়তে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা।
তবে গত সোমবারের নৌকাটি থেকে অর্ধ শতাধিক রোহিঙ্গা লাফিয়ে নেমে সমুদ্র সাঁতরে তীরে ওঠার চেষ্টা করেন। এছাড়া কর্মকর্তরা আবিষ্কার করেন যে, রোহিঙ্গারা নৌকাটি ইচ্ছাকৃতভাবে ছিদ্র করে মেরামতের অযোগ্য করে রেখেছে। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা ওই নৌকার ২৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করে তীরে নিয়ে যান।
হাঁটতেই পারছেন না ৭০ ভাগ
সোমবার তীরে পৌঁছানো এবং বুধবার সমুদ্রে শনাক্ত রোহিঙ্গা বোঝাই দুটি নৌকাই বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে রওয়ানা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মালয়েশিয় কোস্ট গার্ডের প্রধান।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংহিসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে রাখাইন থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বর্তমানে প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন।
“সিন্ডিকেট তাঁদেরকে খাদ্য ও নৌকার জ্বালানি সরবরাহ করছে। সহায়তা ছাড়া কোনো নৌকার পক্ষেই চার মাস সমুদ্রে ভেসে থাকা সম্ভব নয়,” বলেন মোহাম্মদ জুবিল।
সোমবারে আটক ২৬৯ রোহিঙ্গার করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হচ্ছে জানিয়ে জুবিল বলেন, তিনি লক্ষ করেছেন দীর্ঘদিন জড়োসড়ো হয়ে নৌকায় বসে থাকার কারণে এদের প্রায় ৭০ ভাগই ভালো করে হাঁটতে পারছেন না।
এদিকে লঙকাওয়ি দ্বীপে আটক রোহিঙ্গা দলটির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাতিংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কর্মকর্তারা।
“এখন পর্যন্ত দলটি সম্পর্কে ইউএনএইচসিআর’এর কাছে সরাসরি কোনো তথ্য নেই, ফলে তাঁরা কোত্থেকে এসেছেন এবং তাঁদের পরিস্থিত কী সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়,” বেনারকে জানান জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার কুয়ালালামপুরের এক কর্মকর্তা।
তিনি জানান, দলটির দ্রুত সহায়তা ও সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করতে তাঁদের সাথে দ্রুত সরাসরি যোগাযোগের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।
পাশাপাশি, গত দুই মাসের মধ্য প্রথমবারের মতো কোনো শরণার্থী নৌকাকে মানবিক কারণে তীরে ভিড়তে দেবার জন্য মালয়েশিয়াকে ধন্যবাদও জানিয়েছে জাতিসংঘ।
অভিবাসীদের মাধ্যমে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় মালয়েশিয়া সম্প্রতি তাদের স্থল ও জলসীমায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
“শরণার্থী ও আশ্রয়প্রাথীদের তীরে ভিড়তে দেওয়া আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন রক্ষাকারী একটি পদক্ষেপ,” বলেন জাতিসংঘের ওর কর্মকর্তা।
‘মালয়েশিয়ার উচিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার পাঠানো’
মালয়েশিয়াতে আটক রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে গিয়ে থাকলে তাঁদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে বলে মঙ্গলবার জানান দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব।
তবে রোহিঙ্গাদের নেবার কোনো দায় বাংলাদেশের নেই বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
বাংলাদেশ আর কোনো রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করবে না জানিয়ে মঙ্গলবার আবদুল মোমেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, মালয়েশিয়ার উচিত তাঁদেরকে বাংলাদেশ পাঠানোর চিন্তা না করে মিয়ানমার পাঠানো। আর তা না হলে তারাই রোহিঙ্গাদের রাখুক।”
এদিকে রোহিঙ্গাদের নৌকাকে তীরে ভিড়তে দেবার জন্য আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস।
“এই অঞ্চলের দেশগুলোর জরুরি ভিত্তিতে মানব পাচারের শিকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তীরে ভিড়তে দেওয়া উচিত। রোহিঙ্গারা গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া জনগোষ্ঠী, তাঁদের সুরক্ষার প্রয়োজন এবং কোনোভাবেই তাঁদের সমুদ্রে মৃত্যুর মুখে ফেলে রাখা উচিত নয়,” বুধবার ব্যাংককে বেনারকে বলেন ফর্টিফাই রাইটসের গবেষক পুথানে কাঙকুন।
শরণার্থীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখাও উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন কাঙকুন।
এর আগে গত ৫ এপ্রিল মালয়েশিয়ার লঙকাওয়ি দ্বীপে ২০২ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে একটি নৌকা পৌঁছেছিল। এরপর ১৬ এপ্রিল একটি নৌকা প্রায় ২০০ রোহিঙ্গাকে নিয়ে দেশটিতে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাঁদের আবার আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাড়িয়ে দেয় মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী।
তবে ওই পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার দায়ে মালয়েশিয়ার কঠোর সমালোচনা করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
তার মাত্র একদিন আগে উপকূলীয় জলসীমা থেকে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে বাংলাদেশ, যারা মালয়েশিয়ার তীরে ভিড়তে ব্যর্থ হয়ে প্রায় দুই মাস সমুদ্রে ভেসে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
দুই মাসের এই সমুদ্রযাত্রায় বেশ কয়েকজন যাত্রী মারা যান বলে তখন বেনারকে জানিয়েছিলেন ফিরে আসা যাত্রাীরা।