ভাসানচরে রোহিঙ্গা বিক্ষোভ: ১৫ জন আটক, গ্রেপ্তার আতঙ্কে শরণার্থীরা

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2021.06.11
কক্সবাজার ও ঢাকা
ভাসানচরে রোহিঙ্গা বিক্ষোভ: ১৫ জন আটক, গ্রেপ্তার আতঙ্কে শরণার্থীরা জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের সফরের সময় মাসিক ভাতা, কর্মসংস্থান, উন্নত চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে নোয়াখালীর ভাসানচরে বিক্ষোভ করেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ৩১ মে ২০২১।
[বিশেষ ছবি, বেনারনিউজ]

জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ধ্বংসাত্মক বিক্ষোভে তৃতীয় কোনো পক্ষের ইন্ধন ছিল কিনা তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। 

ওই ঘটনায় নৌবাহিনীর দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৫ শরণার্থী গ্রেপ্তার হলেও তাঁদের কাছ থেকে এ বিষয়ক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানিয়েছেন ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম। 

গত ৩১ মে-তে বিক্ষোভকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক এবং উসকানিমূলক বিভিন্ন শ্লোগান দিয়েছে উল্লেখ করে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সংঘবদ্ধভাবে নাশকতার উদ্দেশ্যে দা, ছুরির মতো বিভিন্ন প্রকার ধারালো অস্ত্র, লোহার রড ও লাঠি নিয়ে এসে হুট করেই দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল তারা।

“রোহিঙ্গারা কারো ইন্ধনে এমনটা করে থাকলে মামলার তদন্তে তা অবশ্যই বেরয়ে আসবে। বিষয়টি মাথায় রেখেই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ,” বলেন ওসি রফিক। গত ৫ থেকে ৮ জুনের মধ্যে আটক হওয়া ওই রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতে সোপর্দ করার পর নোয়াখালী জেলে পাঠানোর কথাও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। 

ওই বিক্ষোভের ঘটনায় ৪ জুন থানায় মামলা করেন ভাসানচরে নৌবাহিনীর ফরোয়ার্ড বেইজের সিনিয়র চীফ পেটি অফিসার এম রফিকুল ইসলাম। তাঁর দায়ের করা এজাহারের অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে। 

বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী ৩৫ জন রোহিঙ্গা নেতাসহ আনুমানিক নয়শ' থেকে এক হাজার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে সেখানে। সেদিনের ভাংচুরের ঘটনায় প্রায় ৩৪ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

ইউএনএইচসিআরের কার্যক্রম পরিচালনা বিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজাও এবং সুরক্ষা বিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার গিলিয়ান ট্রিগস সরকারি আয়োজনে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের দেখতে গেলে তাঁদের সামনেই মাসিক ভাতা, কর্মসংস্থান, উন্নত চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে বিক্ষোভ করেছিল শরণার্থীরা। 

মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ মে সকাল ১০টার দিকে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা ভাসানচরে পৌঁছানোর পরপরই ৩৫ জন রোহিঙ্গার নেতৃত্বে নয়শ' থেকে এক হাজার শরণার্থী বিক্ষোভ শুরু করেন।

দুপুর দুইটা পর্যন্ত তাণ্ডব চালানোর সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বপালনে হিংস্রভাবে বাঁধা দেন তারা। নৌবাহিনীর সামরিক এলাকা ও হ্যালিপ্যাডের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে একটি হেলিকপ্টার ভাংচুরেরও চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা।

তাঁদের হামলায় নৌবাহিনীর তিন ও পুলিশের দুই সদস্য আহত হয়েছেন বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ভাসানচরে গ্রেপ্তার আতঙ্ক

ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি গুচ্ছগ্রামের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নুর ইসলাম বেনারকে বৃহস্পতিবার বলেন, “মামলাটি নিয়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে বেশ ভয় কাজ করছে। অনেকে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।”

“কে বা কারা ওইদিন বিক্ষোভের আয়োজন করেছে তা আমিও জানি না। এরপরও গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে রাতে নিজের ঘরে থাকছি না। আমার মতো অনেকেই এভাবে লুকিয়ে থাকছে,” বলেন তিনি।

আরেক গুচ্ছগ্রামের রোহিঙ্গা নেতা মো. জোবাইর বলেন, “কিছু রোহিঙ্গার জন্য এখন প্রায় সবাই ভয়ে আছে। কারণ ওই মামলার সন্দেহভাজন হিসেবে যে কেউ যখন-তখন গ্রেপ্তার হতে পারে।”

কক্সবাজারে অবস্থানকারী আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “মামলার হওয়ার পর ভাসানচর থেকে অনেকে ফোনে জানিয়েছে তারা গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে আছেন।”

“যদিও জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সামনে যে-ঘটনাটি ঘটেছে সেটি দুঃখজনক। তবে মামলার কারণে নতুন করে অনেকে সেখান থেকে পালানোর করবে,” বলেন তিনি।

সর্বশেষ বুধবার ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাবার সময় তিন রোহিঙ্গা এবং তাঁদের সহায়তাকারী দুইজনকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে ওসি রফিকুল বলেন, ট্রলারসহ তাঁদের আটক করেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড।

“দিন যত যাচ্ছে ভাসানচরে পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। তাই আমরাও নজরদারি বৃদ্ধি করেছি,” বলেন তিনি।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “অনেক দিন আগে থেকেই কক্সবাজার থেকে একলাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো, কিন্তু যখন শুরু হলো তখন সরকার তাড়াহুড়ো করেছে। খুবই অপ্রস্তুত ও অগোছালোভাবে এটা শুরু হয়েছে। এভাবে যখন কিছু শুরু হয়, সেখানে কিছু সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক।”

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, “স্থানান্তরের জন্য রাজি করাতে কিছু টাকা-পয়সা দেওয়াসহ যেসব কৌশল সরকার প্রয়োগ করেছে, তাতে রোহিঙ্গারা স্বপ্রণোদিত হয়ে যেতে রাজি হয়েছে তা বলার সুযোগ নেই। যার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাঁকে যদি খুব বেশি বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া না হয়, তখন যেটা করতে বলা হবে সেটা করতে সে প্রায় বাধ্যই হবে। তাদের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।” 

সরকার ও জাতিসংঘ আলোচনা

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে একটি নীতিমালার খসড়া করতে সরকার ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বৃহস্পতিবার।

ঢাকার সচিবালয়ে সভাটি শেষে কমিটির প্রধান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন সাংবাদিকদের জানান, আগামী ১৭ জুনের মধ্যে খসড়া নীতিমালাটি তৈরি করবে কমিটি। তাঁর প্রত্যাশা, সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়া পুনরায় শুরু করতে পারবে সরকার।

“ভাসানচরে এই মুহূর্তে ১৮ হাজার ৮৯০ জন শরণার্থী আছে। আমাদের টার্গেট হলো সেখানে মোট এক লাখ নিয়ে যাব। সেজন্যই এই কমিটি করা হয়েছে,” বলেন তিনি।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি ইয়োহানেস ভ্যান ডার কালাউ সাংবাদিকদের জানান, ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ইস্যুতে সরকারের সাথে কয়েকটি নীতির বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যার ভিত্তিতে তারা সেখানে সক্রিয় হতে যাচ্ছে।

“ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় এবং তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কোনো শরণার্থীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখানে আটকে রাখা যাবে না। তাঁদের চলাচলের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি করতে হবে,” বলেন তিনি।

সম্প্রতি একান্ত আলাপে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বেনারকে বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের “কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। মোট ৩৪টি এনজিও-কে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”

“খুব শিগগির জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো সেখানে কক্সবাজারের মতোই কাজ শুরু করবে,” বলেন মন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।