অনুমতি ছাড়াই রোহিঙ্গাদের তথ্য শেয়ার করেছে জাতিসংঘ: এইচআরডব্লিউ

জেসমিন পাপড়ি
2021.06.15
ঢাকা
অনুমতি ছাড়াই রোহিঙ্গাদের তথ্য শেয়ার করেছে জাতিসংঘ: এইচআরডব্লিউ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেবার পর কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে নাম নিবন্ধনের জন্য অপেক্ষা করছেন রোহিঙ্গারা। ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
[জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অনুমতি ছাড়াই তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য বাংলাদেশের মাধ্যমে মিয়ানমারের হাতে তুলে দেবার অভিযোগ তুলেছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

ইউএনএইচসিআর তিন বছরেরও বেশি সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের জন্য তথ্য সংগ্রহ করছে জানিয়ে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এই অভিযোগ করে এইচআরডব্লিউ।

“বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বুঝতে পারেননি যে, ইউএনএইচসিআরের সংগ্রহ করা ছবি, আঙুলের ছাপসহ তাঁদের অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য বাংলাদেশ সরকার সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের জন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারকে দেবে,” জানায় এইচআরডব্লিউ।

এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সংকট ও সংঘাত বিষয়ক পরিচালক লামা ফাকিহ বলেন, “জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমগুলো সংস্থাটির নিজস্ব নীতির পরিপন্থী ছিল, যা শরণার্থীদের আরও ঝুঁকির মুখোমুখি করেছে।”

তবে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইউএনএইচসিআর।

এ বিষয়ে সংস্থাটির বাংলাদেশের যোগাযোগ কর্মকর্তা লুইস ডোনোভান এক ইমেইল বার্তায় বেনারকে জানান, “সারা বিশ্বে শরণার্থীদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্য নিরাপদে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার একটি স্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে।”

“বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে নিবন্ধনের সময় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারকে নিবন্ধনের উদ্দেশ্য জানায়। তাদের বলা হয়, নিরাপত্তা ও সহায়তা দেওয়া, তারা যাতে মিয়ানমারে ফিরতে এবং ফিরে যাবার অধিকার পেতে পারেন, সেজন্য তাঁদের তথ্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে,” বলেন ডোনোভান।

তিনি জানান, “বাংলাদেশ সরকার এসব তথ্য মিয়ানমার সরকারকে দিতে চায়— এ বিষয়ে সম্মতি নিতে শরণার্থীদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা হয়। নিবন্ধন কার্যক্রমের উদ্দেশ্য যেন তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন সে জন্য প্রতিটি শরণার্থীকে আলাদা করে তাঁদের মাতৃভাষায় বোঝানোর পাশাপাশি তাঁদের উদ্বেগ দূর করতে সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়।” 

ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র বলেন, “রোহিঙ্গাদের কাছে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়, তা হলো- তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বিনিময়— এই দুটি বিষয় একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পৃক্ত নয়। যে কেউ চাইলে তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অসম্মতি জানাতে পারেন।”

“প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে দুই দফায় সম্মতি নেওয়া এবং তা নথিভুক্ত করা হয়,” জানিয়ে ডোনোভান বলেন, “তাঁদের বোঝানো হয়, যারা মিয়ানমার সরকারকে তথ্য দিতে চান না, তাঁরাও নিবন্ধন করতে পারবেন এবং অন্যান্য শরণার্থীদের সমান সুবিধা ভোগ করবেন।”

প্রত্যাবাসনের জন্য তথ্য শেয়ার ‘জরুরি’

এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারকে তথ্য দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গাদের স্বার্থেই। যাতে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন সেই বিশেষ উদ্দেশ্যে।”

বাংলাদেশ সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ইউএনএইচসিআর তথ্য সংগ্রহ করে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, “এই তথ্য না পেলে মিয়ানমার কীভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই করবে?”

“রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে মানুষ। তাঁদের সেখানেই ফেরত যেতে হবে। আর এর জন্য তথ্য শেয়ার অত্যন্ত জরুরি,” বলেন তিনি।

এইচআরডব্লিউ’র বিবৃতিকে “বাস্তব পদক্ষেপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়,” বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “ইউএনএইচসিআরের সাথে যখন বাংলাদেশ যৌথভাবে কাজ করে কোনো তথ্য মিয়ানমারকে পাঠায়, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তাছাড়া তথ্য না দিলে মিয়ানমার তাঁদের স্বীকৃতি দেবে কীভাবে?” 

নিবন্ধন শুরুর প্রথম দফায় তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন জানিয়ে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের সৈয়দ আলম বেনারকে বেনারকে বলেন, “কেন নিবন্ধন করা হচ্ছে জানতে চাইলে একজন বিদেশি ও বাংলাদেশি কর্মীর সঙ্গে থাকা এক রোহিঙ্গা আমাদের ভাষায় বলেছিল- বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি আমাদের বার্মায় ফিরতে এই তথ্য কাজে লাগবে।”

“তবে সব রোহিঙ্গাকে এই তথ্য দেওয়া হয়নি। যারা মিয়ানমারে ফিরতে চাননি তাদের বলা হয়েছিল, শুধু সাহায্য পেতে এই ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে,” বলেন সৈয়দ আলম।

প্রতিবেশী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা থেকে বাঁচতে ২০১৬ সাল থেকে মিয়ানমার আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা একে জাতি নিধনের জন্য গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সব রোহিঙ্গা অবহিত নন

হিউম্যান রাইট ওয়াচ জানায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছর মার্চ মাস পর্যন্ত নিবন্ধন বিষয়ে ২৪ জন শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নেয় সংস্থাটি।

এছাড়া যারা রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন, পর্যবেক্ষণ করেছেন এমন ২০ জন মানবিক সহায়তা কর্মী, বিশ্লেষক, স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকের সঙ্গেও কথা বলেছে তারা।

২৪ রোহিঙ্গার মধ্যে একজন ছাড়া সবাই জানিয়েছেন, ইউএনএইচসিআর কর্মীরা তাদের বলেছিল, সহায়তার জন্য স্মার্ট কার্ড পেতে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তারা প্রত্যাবাসনের জন্য এসব তথ্য মিয়ানমারের সাথে শেয়ার করার বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেনি।

তবে তিনজন বলেছেন, তথ্য দেওয়ার পর তাঁদের বলা হয়েছিল যে এটি প্রত্যাবাসনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে।

শরণার্থী জানান, তথ্য সংগ্রহের ফর্মে শুধু ইংরেজিতে হ্যাঁ অথবা না সূচক ঘরে টিক দেবার সুযোগ ছিল। এক্ষেত্রে সবাই হ্যাঁ দিয়েছেন। তবে এই হ্যাঁ-না সম্মতির ব্যাপারে ইউএনএইচসিআরের কর্মীরা কাউকে কখনও জিজ্ঞাসা করেননি।

একজন বলেছেন, নিবন্ধনের সময় ইউএনএইচসিআরের কর্মীরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি মিয়ানমারের সাথে তথ্য শেয়ার করতে রাজি কিনা। এক্ষেত্রে না বললে হয়ত কার্ড পাবেন না ভেবে তিনি ‘না’ বলেননি বলে জানান।

তথ্য সংগ্রহের সময় ইউএনএইচসিআর স্বাধীনভাবে এবং অবহিত করে রোহিঙ্গাদের সম্মতি চায়নি বলে অভিযোগ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। 

প্রত্যাবাসন সম্মতির ভিত্তিতে হবে

প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার বায়োমেট্রিক এবং অন্যান্য তথ্যসহ মিয়ানমারের কাছে কমপক্ষে আট লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার নাম জমা দিয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার প্রায় ৪২ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরত নিতে সম্মত হয়েছিল। যার ভেতর আছেন সাক্ষাৎকার দেয়া ২১ জন শরণার্থীও।

এইচআরডব্লিউ জানায়, ওই ২১ জন বলেছেন, নিবন্ধনভুক্ত হওয়ার পরে তাঁরা জানতে পারেন যে, তাঁদের তথ্য মিয়ানমারের সাথে শেয়ার করা হয়েছে এবং তাঁদের নামগুলো প্রত্যাবর্তনের জন্য যাচাই করা লোকদের তালিকায় রয়েছে। 

তাঁদেরকে জোর করে মিয়ানমার ফেরত পাঠানো হতে পারে ভেবে তাঁরা সবাই অন্য ক্যাম্পে লুকিয়ে ছিলেন বলেও জানান তাঁরা। যদিও এখনও পর্যন্ত, বাংলাদেশ কোনো রোহিঙ্গাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করেনি।

“ইউএনএইচসিআর শুরু থেকেই জোর দিয়ে আসছে— রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন অবশ্যই প্রত্যেকের সম্মতির ভিত্তিতে হবে। যখন তাঁরা পরিস্থিতি অনুকূলে মনে করবেন, তখন তাঁদের ফেরত পাঠানো হবে,” বেনারকে বলেন লুইস ডোনোভান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।