রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিপক্ষের গুলিতে এক আরসা সদস্য নিহত

কামরান রেজা চৌধুরী ও আবদুর রহমান
2022.06.16
ঢাকা ও কক্সবাজার
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিপক্ষের গুলিতে এক আরসা সদস্য নিহত কক্সবাজারের বালুখালী শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি আজিম উদ্দিন খুব হবার পর ঘটনাস্থলের কাছে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা। ১১ মে ২০২২।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিপক্ষের হামলায় মিয়ানমার ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) এক সদস্য নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে নিহত কোনো রোহিঙ্গাকে আরসা সদস্য বলে জানানো হলো।

বুধবার আনুমানিক রাত পৌনে দশটায় উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে “রোহিঙ্গা অপরাধীচক্র মুন্না গ্রুপের গুলিতে নিহত হয় কথিত আরসা সদস্য মো. সেলিম (৩০),” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক মো. নাইমুল হক।

তিনি বলেন, “নিহত সেলিম কথিত আরসা গোষ্ঠীর সমর্থক। ‘মুন্না গ্রুপ’ নামের অপর একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করেছে।”

কীভাবে তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে সেলিম আরসার সমর্থক- এমন প্রশ্নের উত্তরে নাইমুল হক বলেন, “আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে।”

এ প্রসঙ্গে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২ (ওয়েস্ট), ব্লক-সি এলাকায় মুন্না গ্রুপের কিছু দুষ্কৃতিকারী কথিত আরসা গ্রুপকে লক্ষ্য করে ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। পরবর্তীতে কথিত আরসা সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে। ওই ঘটনায় কথিত আরসা সদস্য মো. সেলিম (৩০) বুকের বাম পাশে গুলিবিদ্ধ হয়।

গুলিবিদ্ধ সেলিমকে শরণার্থী শিবিরের মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

এক সপ্তাহে তিন খুন

এ নিয়ে সেলিমসহ গত এক সপ্তাহে রোহিঙ্গা শিবিরে তিনজন রোহিঙ্গা নিহত হলেন।

এর আগে শুক্রবার রাতে কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিনের (৩০) হাত-মুখ বাঁধা রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয় এবং বৃহস্পতিবার রাতে রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এ ছাড়া গত মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামের দুই স্বেচ্ছাসেবক।

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ এবং মাদ্রাসায় ছয় খুন হওয়ার পর অক্টোবর মাস থেকে স্বেচ্ছায় শিবিরে পাহারা চালু করা করা হয়েছে।

বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় নয় হাজার তিনশ সেচ্ছাসেবী সক্রিয় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন শরণার্থীরা।

সাধারণ রোহিঙ্গারা জিম্মি’

মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি রাখাইন রাজ্য থেকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে উৎখাতের নেপথ্যে আরসাকে দায়ী করা হয়।

জঙ্গি সংগঠনটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায়।

এই হামলার জবাবে সর্বাত্মক ও নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধ জঙ্গি।

প্রাণ বাঁচাতে কয়েক দিনের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।

তাঁদের এখনও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার সরকার।

সরকারি হিসাবে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন, যাদের আন্তর্জাতিক সহায়তায় খাবারসহ বিভিন্ন মৌলিক উপাদান সরবরাহ করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ডাকাতি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে আরসা সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা গণমাধ্যমে উঠে আসলেও পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনই তা স্বীকার করা হয়নি।

বলা হতো, এরা রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক অপরাধী চক্র এবং এরা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে আরসার নাম ব্যবহার করে।

তবে গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর লাম্বারশিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী শিবিরে আরসা সদস্যদের উপস্থিতি স্বীকার করে পুলিশ।

চলতি সপ্তাহে আদালতে দাখিল করা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, মুহিব উল্লাহ আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীর চেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে যাচ্ছিলেন বিধায় তাঁকে হত্যা করে আরসার সদস্যরা।

মুহিব উল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর কারণে আরসার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

কর্মহীন হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের অনেকেই জঙ্গিবাদসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কাজে জড়াচ্ছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শিবির কেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধী গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে যারা মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, মানবপাচার, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ করছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের হাতে জিম্মি। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”

মোহাম্মদ আলী বলেন, “সরকারের উচিত শিবিরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে সকল সন্ত্রাসী, অপরাধী গ্রুপকে দমন করা।”

“যেহেতু তদন্তে আরসার নাম এসেছে সেহেতু ওই সন্ত্রাসী সংগঠন সংশ্লিষ্টদের কম্বিং অপারেশনের মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে,” মনে করেন ওই বিশ্লেষক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।