ভাসানচরে ডায়রিয়ায় পাঁচ রোহিঙ্গার মৃত্যু, আক্রান্ত হাজারের বেশি

শরীফ খিয়াম ও আবদুর রহমান
2021.06.17
ঢাকা ও কক্সবাজার
ভাসানচরে ডায়রিয়ায় পাঁচ রোহিঙ্গার মৃত্যু, আক্রান্ত হাজারের বেশি ভাসানচরে একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার জন্য শিশুদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন রোহিঙ্গা নারীরা। ১৩ জুন ২০২১।
[বিশেষ ছবি, বেনারনিউজ]

নোয়াখালীর ভাসানচরে চলতি মাসে হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানালেও শরণার্থীদের ভাষ্য, আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক হাজার, মারা গেছেন এবং চার শিশুসহ পাঁচজন। 

নোয়াখালী জেলার সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, ভাসানচরে চার শিশুসহ পাঁচজন মারা গেলেও একজনের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। বাকিদের ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। 

ভাসানচরে গত ১৫ দিনে দেড় থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার যে খবর স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা সত্য নয় দাবি করে তিনি বলেন, “এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ছয়শ জন।” 

“এ ছাড়া হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যারা চিকিৎসা নিয়েছে তাঁদের হিসেব ধরলেও মোট ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হাজারখানেক হবে,” বলেন ডা. মাসুম। 

ভাসানচরের ডায়রিয়া আক্রান্তদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই জানিয়ে ওই দ্বীপে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি ক্যাম্প-ইন-চার্জ (সিআইসি) মোহাম্মদ আতিকুল মামুন বেনারকে জানান, “এখানে কিছু ডায়রিয়ায় রোগী পাওয়া যাচ্ছে এবং সরকার এ ব্যাপারে সজাগ রয়েছে।” 

তবে ভাসানচর থেকে মুঠোফোনে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবাইর বেনারকে বলেন, “গত দুই সপ্তাহে এখানকার দুই-তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে চার শিশুসহ পাঁচ জন মারা গেছে। এখনো অনেকে চিকিৎসাধীন রয়েছে।” 

মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নামে আরেক রোহিঙ্গা নেতা বেনারকে বলেন, “প্রায় সবগুলো ‘ক্লাস্টার’ (গুচ্ছগ্রাম) থেকে প্রতিদিন ১০-১৫ জন বাসিন্দা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে। সেখানে জায়গা না পেয়ে অনেকে নিজের ঘরেই চিকিৎসা নিচ্ছে।” 

বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ভাসানচর ২০ শয্যা হাসপাতালে “২৫ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি আছে,” জানিয়ে ওই হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রাহাত তানভীর আনোয়ার বেনারকে বলেন, “এখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।” 

গত তিন দিন ধরে ভাসানচরে সংক্রমণ কমে আসায় বর্তমানে “প্রতিদিন ১৫-১৬ জন করে নতুন রোগী আসছে,” জানান জেলার সিভিল সার্জন। 

ডায়রিয়া প্রতিরোধে রোহিঙ্গাদের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর করা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। 

ভাসানচরে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিওর ছয়টি ‘হেলথ পোস্ট’ রয়েছে। বর্তমানে দ্বীপে “ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমছে,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান প্রান্তিক নামক এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মকর্তা ডা. ইয়াসিন রাজু। 

গত এপ্রিল থেকেই নোয়াখালীতে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সিভিল সার্জন জানান, ভাসানচরের বাইরেই চলতি মাসে ওই জেলায় মোট সাত ডায়রিয়া রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর আগে এপ্রিল ও মে মাসে মারা যায় ১৪ জন। 

সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি

রোহিঙ্গা নেতাদের ধারণা, খাবার পানি দূষণ থেকেই ভাসানচরে ডায়রিয়া ছড়িয়েছে। তবে ভাসানচরে পানিবাহিত এই রোগটির প্রাদুর্ভাবের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন এবং সিআইসি। 

যদিও রোহিঙ্গা নেতাদের মতো সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আনোয়ারেরও ধারণা, পানি দূষণ এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। 

“রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘পারসোনাল হাইজিন’ (ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি) মেনে চলার প্রবণতা একেবারেই কম। খুব একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও থাকে না,” বলেন ডা. আনোয়ার। 

দ্বীপে খাওয়ার পানিতে কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা তা দেখার পাশাপাশি রোহিঙ্গারা সেখানে রান্নায় কী ধরনের পানি ব্যবহার করেন, পায়খানার পর তাঁদের হাত ধোয়ার অভ্যাস আছে কিনা এবং গরমে তাঁদের খাবার কতটা ভালো থাকছে, এসব বিষয়ও দেখা দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহবুবুর রহমান। 

স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে রোহিঙ্গাদের আগ্রহী করতে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “তাঁদের ভাষায় ‘মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট’ তৈরি করে সেগুলো বারবার দেখালে সুফল মিলতে পারে।”

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতেও “এক সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ ছিল,” বলে বেনারকে জানান আরআরআরসি কার্যালয়ের প্রধান স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা এম আর এইচ ভূঁইয়া।

তবে অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন থেকে বিরত থাকা এবং পরিচ্ছন্ন উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণ করা বিষয়ে নিয়মিত প্রচারণার ফলে এখন সেখানে “মাঝেমধ্যে দুই-একজন” মাত্র ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত মার্চের তথ্যমতে দেশে ডায়রিয়ায় ২০১৯ সালে সাত হাজার ২১৩ জন ও ২০২০ সালে সাত হাজার ২০১ জন মারা যান।

চলতি বছর বরিশাল, ভোলাসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়, যা এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত চলতি বছরের সারাদেশের ডায়রিয়া পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য নেই বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 

ভাসানচর যাবে আরো ৮০ হাজার রোহিঙ্গা

নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে বর্তমানে প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। কক্সবাজার থেকে সেখানে আরো ৮০ হাজার রোহিঙ্গা স্থানান্তর করার বিষয়ে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করবে বলে গত সপ্তায় জানিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। ওই খসড়াটি আগামী সপ্তাহ নাগাদ পাওয়া যেতে পারে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

পরবর্তীতে সংস্থাগুলোর সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশ সরকার নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।

তবে রোহিঙ্গাদের মতামত না নিয়ে এধরনের কোনো নীতি চূড়ান্ত করলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে তা ফলপ্রসূ নাও হতে পারে বলে বৃহস্পতিবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর।

তাঁর মতে, এ ধরনের নীতিমালা তৈরিতে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।