‘বন্দুকযুদ্ধে’ চার রোহিঙ্গা নিহত, পুলিশের দাবি ডাকাত
2020.06.26
ঢাকা ও কক্সবাজার
কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। পুলিশের দাবি, তাঁরা ডাকাত দলের সদস্য। শুক্রবার দুপুরে টেকনাফের হোয়াক্যং পাহাড়ে এ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে।
নিহতদের মধ্যে দুজন সহোদর; বশির আহমদ (৪০) ও মোহাম্মদ হামিদ (৩৮)। পুলিশের ভাষ্য, তাঁরা রোহিঙ্গা ডাকাত আব্দুল হাকিমের ভাই। অপর দুজন হচ্ছেন; মো. রফিক (৩২) ও ২৮ বছর বয়সের অজ্ঞাতনামা একজন।
কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিম বাহিনীর সদস্যরা টেকনাফের শাপলাপুর ও উখিয়া মনতলী পাহাড়ের মাঝামাঝি হোয়াক্যং পাহাড়ে অবস্থান করছে, গোপনসূত্রে এই খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়।
“পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাত দলের সদস্যরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে চারজন মারা যায়,” জানান ইকবাল হোসাইন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “দেখুন আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র, মাদক উদ্ধার অথবা তাঁদের ‘আত্মরক্ষার্থে ছোড়া গুলিতে’ নিহত হওয়ার ঘটনা অনেকদিন ধরে শুনে যাচ্ছি। এগুলো আর মানুষ বিশ্বাস করে বলে আমার মনে হয় না।”
তিনি বলেন, “যে চারজন নিহত হয়েছেন তাঁরা যদি ডাকাত হয়েও থাকেন, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত ছিল তাঁদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা।”
“করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে, গণতান্ত্রিক চর্চার পথ সঙ্কুচিত হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য খুব ভালো খবর নয়,” বলেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দরকার
শুক্রবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের জরিপ অনুযায়ী, দশটি রোহিঙ্গা শিশুর মধ্যে চারটি মনে করে তারা অথবা তাদের পরিবারের কোনো সদস্য করোনাভাইরাস সংক্রমণে মারা যেতে পারেন।
মনোবিদদের মতে, রোহিঙ্গা শিশুরা রাখাইনে বিভৎস নির্যাতন প্রত্যক্ষ করার কারণে তাদের মধ্যে ভয় গেঁথে গেছে। বিনোদন এবং শিক্ষার মাধ্যমে তাদের এই ভয় দূর করা সম্ভব। এ জন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক এবং শিশু ও বয়োসন্ধিকাল শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিশুরা তাদের জীবনে বিভৎস রকমের সহিংসতা দেখেছে। তাদের সামনে তাদের বাবা-মা, ভাই-বোনকে হত্যা করা হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং, সামান্য রকমের বিপদের সম্মুখীন হলে তাদের মধ্যে মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয়াটা অস্বাভাবিক বিষয় নয়।”
তাঁর মতে, এই আতঙ্ক থেকে তাদের বের করে আনতে হলে কোভিড-১৯ সম্পর্কে জানানোর পাশাপাশি তাদের বোঝাতে হবে যে, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হবে না।
“এর পাশাপাশি তাদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, কোনো কারণে যদি তাদের অথবা তাদের পরিবারের কোনো সদস্য কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা রয়েছে; ভয় নেই,” বলেন ড. হেলাল।
এছাড়া শিশুদের জন্য কিছু বিনোদন ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন ড. হেলাল।
এদিকে সেভ দ্য চিলড্রেনের জরিপ প্রতিবেদনটি সম্পর্কে এখনো তাঁরা ‘পুরোপুরি অবগত নন’ জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান বেনারকে বলেন, “তবে শতকরা ৪০ ভাগ শিশু যদি মৃত্যুর আশঙ্কা বোধ করে সেটি একটি চিন্তার বিষয়।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন বেসরকারি ও দাতা সংস্থা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য সামাজিক-মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়ে থাকে। সেটি যথেষ্ট কি না, তা দেখা প্রয়োজন।”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “তবে এ কথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে শুধু রোহিঙ্গা শিশু নয়, সকলকে যথাসাধ্য সহয়তা দিয়ে আসছি। করোনা আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য আমরা প্রায় দুই হাজার শয্যার হাসপাতাল করছি। সেখানে আক্রান্তদের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
এনামুর রহমান বলেন, “সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ খুবই কম। বারো লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন মাত্র পাঁচজন। সুতরাং, আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই।”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবনযাপনের জন্য আমরা ভাসানচরে উন্নত আবাসিক ব্যবস্থা করেছি। সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নেই। সেখানে গেলে তারা ভালো থাকবে; শিশুরা খোলামেলা পরিবেশে বড় হতে পারবে।”
এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে শরণার্থী শিবিরের সবগুলো শিশু শিক্ষাকেন্দ্র ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে বলে বেনারকে জানান ব্র্যাক মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আঞ্চলিক পরিচালক হাসিনা আখতার।
“কবে নাগাদ এগুলো চালু করা যাবে তাও অনিশ্চিত,” জানিয়ে হাসিনা বলেন, “যে কারণে শিশুরা একটু চাপের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে তাদের মানসিক চাপ আরও বাড়বে।”
“তবে এ পরিস্থিতিতে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের কীভাবে উন্নতি ঘটানো যায়, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে,” বলেন তিনি।
ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশান গ্রুপ (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “এ ভাইরাস নিয়ে কমবেশি সবাই ঝুঁকিতে আছে। তবে যেহেতু শিশুদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি, তাই সংক্রমণ কমানোর জন্যই শিবিরের শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এসব বন্ধ থাকায় তাদের বিনোদনের উৎসগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সেকারণে তারা মানসিকভাবে একটু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
শিশুদের মানসিক সুস্থতার জন্য তাঁরা ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে একটা কর্মসূচি চালুর কথা ভাবছিলেন জানিয়ে সৈকত বলেন, “কিন্তু শিবির এলাকায় মোবাইল নেটওর্য়াক না থাকায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।”
“ঘরে ঘরে সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সেলিংসহ ছবি, পোস্টার, বিভিন্ন ম্যাসেজ দেখিয়ে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা অব্যাহত আছে,” বলেন সৈকত।
আরও দুই রোহিঙ্গা করোনা আক্রান্ত
এদিকে শুক্রবার নতুন করে আরও দুইজন রোহিঙ্গার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু মোহাম্মদ তোহা।
তিনি বলেন, এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৯ রোহিঙ্গা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজার ৪৭৪ জন। এখন পর্যন্ত দেশে এই রোগে মারা গেছেন মোট এক হাজার ৬৬১ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৯৬ লাখ ৪১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন চার লাখ ৮৯ হাজারের বেশি।