দালালদের টাকা দিয়ে বাংলাদেশে আসছেন রোহিঙ্গারা
2024.07.02
কক্সবাজার ও ঢাকা
সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও তৎপর রয়েছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মানব পাচারকারী চক্র।
অভিযোগ উঠেছে, অর্থের বিনিময়ে এই চক্রের মাধ্যমে নতুন করে বাংলাদেশে আসছেন রোহিঙ্গারা।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে তৎপর রয়েছে দাবি করা হলেও সম্প্রতি কতজন বাংলাদেশের এসেছেন সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য কোনো কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি।
গত কয়েক সপ্তাহে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছেন বেনার প্রতিবেদক।
তাঁরা জানান, প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। বর্ডার পার হতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের চক্রকে টাকা দিতে হয়েছে।
টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বেনারকে বলেন, “অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে রাতে। নৌ পথে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের প্রবেশ করছে। আমি জানতে পেরেছি রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মিয়ানমারের পাশে নাফ নদীর তীরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে।”
পালিয়ে আসা দুই রোহিঙ্গার বয়ানে মিয়ানমারের পরিস্থিতি
পাঁচ দিন আগে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এক স্বজনের সঙ্গে একটি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মোহাম্মদ সাজে। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে নৌকায় আরও ১২ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।
এই রোহিঙ্গা তরুণ বেনারকে বলেন, “আমার বাড়ি বুথিডাংয়ে। সেখানে যুদ্ধে সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বাবা মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আরাকান আর্মি গ্রামে প্রবেশ করে এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে গ্রামটি খালি করতে বলে। গ্রাম না ছাড়লে সবাইকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। কিছু খাবার নিয়ে আমরা গ্রাম ছেড়ে আসি।
“৬০ জন যুবক আরাকান আর্মির হাতে ধরা পড়েছিল, আমি জানি না তাঁদের পরিণতি কী হয়েছে। পালানোর সময় আমি নিজের চোখে দেখেছি অনেক যুবককে হত্যা করা হয়েছে,” যোগ করে তিনি।
সাজে বলেন, “মংডুতে এসে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে আমরা তিন দিন আশ্রয় নেই। তারপর দালাল মোহাম্মদ ইউনুসের মাধ্যমে প্রত্যেকে চার লাখ কিয়াট দিয়ে পালিয়ে আসি।”
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদে টহল জোরদার রেখেছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। ২ জুলাই ২০২৪। [বেনারনিউজ]
টেকনাফ সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের টহলের কারণে দুই দিন তাঁকে নৌকায় ভাসতে হয়েছে জানিয়ে সাজে বলেন, “প্রবল বর্ষণের মধ্যে এক রাতে আমরা গোলারচর এলাকা দিয়ে শাহপরীর দ্বীপে প্রবেশ করি। সে সময় তিনজন দালাল ছিলেন, আমি তাঁদের আগে কখনো দেখিনি।”
রাখাইনের বুথিডাং এলাকা থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আরেক রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ ইউসুফ বেনারকে বলেন, “আমার গ্রামে হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ হয়। আমার পরিবারের ১৩ জন প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো পালিয়ে যায়। বাকিরা কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে আমি জানি না।”
তিনি বলেন, “আমরা দুই ভাই তিন দিন পাহাড়ি এলাকায় হেঁটে নদী পার হয়েছি। এই যাত্রায় আমাদের সঙ্গে অন্যান্য গ্রামের আরও সাতজন ছিলেন। পাহাড়ে ৪০ দিন থাকতে হয়েছে। খাবার ছিল না, পাতা খেয়ে বাঁচতে হয়েছে।
“যেহেতু আমার দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কেউ এখানে (বাংলাদেশ) ঢুকেছে, আবার কেউ দালালের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছে,” বলেন তিনি।
ইউসুফ জানান, আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলো তরুণদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কারণ যুবকরাই আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মতে, রাখাইনে দুই পক্ষের যুদ্ধের মন্ডু ও বুথিডাংয়ে ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আটকা পড়েছে।
অনুপ্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আমির জাফর বেনারকে বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ চলছে, ফলে সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা সেখানে টিকে থাকতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা এখানে (বাংলাদেশ) আসার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ হয়তো ঢুকেছে।”
পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নেতা মোহাম্মদ হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা যেভাবে জীবনযাপন করছি তা মোটেও ভালো নয়। তবে রাখাইনে রোহিঙ্গারা মৃত্যুর মুখোমুখি, তাই পালিয়ে এখানে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার চেষ্টা করছে।”
অনুপ্রবেশের সময় মাইন বিস্ফোরণে রোহিঙ্গা যুবক নিহত
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ আয়াছ নিহত হয়েছেন।
কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “নিহত যুবকের বয়স আনুমানিক ২২ থেকে ২৫ বছর। বিস্ফোরণে আহত হলে মঙ্গলবার বিকেল ৩টার (স্থানীয় সময়) দিকে তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
“কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যাঁরা ওই রোহিঙ্গা যুবককে সীমান্তে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা পালিয়ে যাওয়ায় আটক করা সম্ভব হয়নি,” বলেন সাইফুল।
এর আগে গত ২২ জুন বাংলাদেশে প্রবেশের সময় একই সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আরেক রোহিঙ্গা যুবক মো. আনোয়ার পা হারান। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।