পুরনো রোহিঙ্গাদের খাবার বয়কট করে বিক্ষোভ, আলোচনায় সমাধান

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2021.08.02
কক্সবাজার ও ঢাকা
পুরনো রোহিঙ্গাদের খাবার বয়কট করে বিক্ষোভ, আলোচনায় সমাধান [আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]
Photo: Benar

কক্সবাজারের দুটি শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত প্রায় ৩৫ হাজার ক্ষুব্ধ রোহিঙ্গা গত এক মাস ধরে খাদ্য সহায়তা বয়কট করে আসছেন, এর বহিপ্রকাশ ঘটে রোববার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায়। 

ওই সংঘর্ষের পর সোমবার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বেনারকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার থেকে রোহিঙ্গারা খাবার নিতে রাজি হয়েছেন। 

টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত শিবিরে ১৯৯২ সাল থেকে অবস্থানকারী ৩৫ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় সবাই নতুন ‘ফুড কার্ড’ (খাদ্য সহায়তা কার্ড) বিতরণের বিরোধিতা করে আসছিলেন।

তাঁদের দাবি, নতুন কার্ডগুলো ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে আসা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা কার্ডের মতোই। এর মাধ্যমে তিন দশক ধরে বসবাসরতদের মাত্র তিন বছর আগে আসা রোহিঙ্গাদের কাতারে ফেলে দেয়া হয়েছে।

“নকশা ও রং বদল করে তাঁদের জন্য নতুন করে কার্ড তৈরির সিদ্ধান্ত হওয়ার পর নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা খাবার নিতে রাজি হয়েছেন। মঙ্গলবার থেকেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি,” বেনারকে বলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ্ রেজওয়ান হায়াত। 

তিন দশকেও সমাধান নেই

রেশন কার্ড নিয়ে আপত্তিসহ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সমস্যা স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে টেকনাফ নয়াপাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের এনজিও থাই কার্যালয়ে অতিরিক্ত আরআরআরসি মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়নের নেতৃত্বে আয়োজিত সোমবারের বৈঠকে ৬০-৭০ জন রোহিঙ্গা নেতা অংশ নেন। সেখানে বেনারের একজন প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। 

বৈঠকে রোহিঙ্গা নারী আসমা খাতুন জানান, “আমরা ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এখানে বসবাস করছি। অনেক কষ্টের সময় পার করে আজ এ পর্যন্ত এসেছি। সেখানে ২০১৭ সালে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলিয়ে কেন আমাদের রেশন কার্ড দেওয়া হচ্ছে? সেজন্য আমরা গত এক মাস ধরে রেশন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। এই কার্ডে অনেক তথ্যবিভ্রাট রয়েছে। এর সমাধান হলে রেশন নিতে প্রস্তুত আমরা।” 

তিনি বলেন, “প্রায় ৩০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে এখানে, আমাদের কোনো সমাধান হচ্ছে না। আমরা সন্তানদের জানমালের নিরাপত্তাসহ তাদের শিক্ষার সুযোগ চাই।” 

নয়াপাড়া শিবিরের মোহাম্মদ আলম জানান, “আমাদের জীবন তো প্রায় শেষের দিকে, কিন্তু সন্তানদের কী হবে? তা ছাড়া নতুন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কেন আমাদের একইভাবে দেখা হবে?” 

২০১৩ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ডাব্লিউএফপির কর্মকর্তারা নিবন্ধিতদের আলাদা তালিকা করেন। কিন্তু চলতি জুলাই মাসের শুরু থেকে পুরোনো রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তার কার্ডগুলো ফেরত নেয় সংস্থাটি। 

এরপর ২০১৭ সালে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পুরোনোদের সংযুক্ত করে আবার কার্ড বিতরণ করা হয়। ওই কার্ড নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এক মাস ধরে রেশন নিচ্ছেন না পুরোনো রোহিঙ্গারা। 

অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীরের মতে, সরকার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে আরো আগেই এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল।

“নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সাথে এটি বিতরণের আগেই পরামর্শ করা যেত,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই কার্ড দিয়ে তাঁদেরও অনিবন্ধিতদের কাতারে ফেলা হচ্ছে কিনা বা এতে তাঁদের সুযোগ-সুবিধা কমে যাবে কিনা—এই শঙ্কা থেকেই এমনটা ঘটেছে।” 

তবে “নতুন কার্ড নিবন্ধিতদের সহায়তায় কোনো ধরনের পরিবর্তন আনেনি,” জানিয়ে আরআরআরসি বলেন, “কোনোভাবে তাদের কেউ ভুল বুঝিয়েছে বলেই তারা গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খাবার বয়কট ও বিক্ষোভ করেছে।”

“নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা মনে করে, তারা যেহেতু আগে এসেছে, এ কারণে তাদের একটু ‘প্রিভিলেজ’ (অগ্রাধিকার) পাওয়া উচিত,” বলেন আরআরআরসি। 

কার্ডের নকশা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) কক্সবাজার কার্যালয়ের মুখপাত্র অ্যান্টোইন ভাল্লাস বেনারকে বলেন, “যেসব শরণার্থী এখনো তাঁদের খাদ্য সহায়তা কার্ড সংগ্রহ করেননি, তাঁরা মঙ্গলবার থেকে তাঁদের পুরনো সহায়তা কার্ড ব্যবহার করে খাদ্য সংগ্রহ করতে শুরু করবেন।”

আগামী দুই মাস তাঁরা এই সুবিধা পাবেন এবং এর মধ্যে সবাইকে নতুন কার্ড দেওয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। 

হামলার ঘটনায় মামলা

অসহযোগ শুরুর ধারাবাহিকতায় রোববার নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা নয়াপাড়া শিবিরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। একপর্যায়ে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ১২ সদস্য এবং চার শরণার্থী আহত হন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করার কথাও বেনারকে জানান এপিবিএন-১৬ অধিনায়ক পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম।

এ ঘটনায় সোমবার এপিবিএনের এক পুলিশ কর্মকর্তা বাদী হয়ে ৩৯ রোহিঙ্গার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৮০/৯০ জনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা দায়ের করেন।

পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করার কথা উল্লেখ করে টেকনাফ নয়াপাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী শিবিরের এপিবিএন ইনচার্জ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবদুল্লাহ বিন কালাম বেনারকে জানান, “পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় নুরুল ইসলাম নামে এক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চলেছে। ক্যাম্পে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য পুলিশ সেখানে টহল দিচ্ছে।’ 

নয়াপাড়া ক্যাম্পের নুর বশর জানান, “রোহিঙ্গারা ফুড কার্ডের জটিলতার সমাধান চেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা এসে তাদের ওপর লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ করে। 

যদিও পুলিশের দাবি হচ্ছে, উত্তেজিত রোহিঙ্গারা পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাসহ ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করেছিল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।