অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ছে এইডস রোগী

সুনীল বড়ুয়া
2022.08.05
কক্সবাজাৱ
অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ছে এইডস রোগী কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইডস আক্রান্ত শিশু সন্তানকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছেন এক রোহিঙ্গা। ৪ আগস্ট ২০২২।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

এক বছর আগে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মো. রহিম উল্লাহর (২৯) স্ত্রী রশিদা খাতুনের (২৮) এইডস ধরা পড়েছিল। চিকিৎসকরে পরামর্শে গত মাসে রহিম নিজে পরীক্ষা করানোর পর দেখা যায় তাঁরও এইচআইভি পজিটিভ।

“আমার স্ত্রীর এইডস ধরা পড়ার তিন মাস আগে জন্ম নেওয়া শিশুসহ আমাদের মোট পাঁচ সন্তান। কিন্তু এখনও তাদের কারো এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়নি,” বেনারকে বলেন রহিম।

এমন অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ বেড়েছে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যেও।

উখিয়ার ৫ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের বি-১ ব্লকের এই দম্পতি বর্তমানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রশিদা জ্বর, ডায়রিয়ার মতো কিছু শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলেও পরে তা ঠিক হয়ে যায় বলে বেনারকে জানান রহিম।

“এর প্রায় এক বছর পর আমারও একই সমস্যা দেখা দিলেও কোনোভাবেই তা ভালো হচ্ছিল না। কোমর ব্যথার পাশাপাশি শরীরের ওজনও কমে যাচ্ছিল। এরপর ডাক্তার এইডস পরীক্ষা করতে বলেন,” বলেন রহিম।

কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে, শুধু গত ১৩ মাসে জেলায় ১৪৬ জনের শরীরের মরণব্যাধি এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৩৬ জনই রোহিঙ্গা। আর ওই সময়ে এইডস আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৬জন।

এর আগের বছর একই সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০০ জনেরও কম এবং মৃত্যু হয় ৯ জনের।

বেশিরভাগই জীবাণু নিয়ে এসেছেন মিয়ানমার থেকে

রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, মিয়ানমারে এইডস আক্রান্তের হার বেশি। আক্রান্তরা বেশিরভাগ মিয়ানমার থেকে জীবাণু নিয়ে এসেছে।”

“তাঁরা খুব বেশি অসচেতন। স্ত্রী এইডসে আক্রান্ত হলে স্বামী যে আক্রান্ত হতে পারে এই বিষয়টিও বেশিরভাগ রোহিঙ্গা জানে না,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “এইডস ছড়ানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে অনিরাপদ যৌন মিলন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই নিরাপদ বা অনিরাপদ মিলনের বিষয়টি বোঝেন না। স্বাস্থ্য বিষয়ে নানা অজ্ঞতা, কুসংস্কার কাজ করে তাঁদের মধ্যে।”

সাড়ে ৬ বছরে শনাক্ত ৯৮৮, গর্ভবতী ১০০

২০১৭ সালে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসার পর ওই জেলায় এইচআইভি এইডস আক্রান্তের হার বেড়ে যায় বলে জানান ডা. মাহবুব।

তিনি জানান, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ছয় বছরে কক্সবাজারে এখন এইডস আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৯৮৮ জন। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা রোগীর সংখ্যা ৭৯৪। ১৯৩ জন স্থানীয় বাসিন্দা।

তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর ৫৯ জন রোহিঙ্গা এবং ৫৭ জন বাংলাদেশিসহ ১১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আক্রান্ত ৯৮৮ জনের মধ্যে ৫০৯ জনই নারী, যাদের মধ্যে ৯১জন রোহিঙ্গাসহ গর্ভবতী নারীর সংখ্যা একশ। এ ছাড়াও আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৩৬৮ জন, শিশু ১১৩ জন এবং তিনজন হিজড়া রয়েছেন বলে জানান তিনি।

‘গণহারে এইচআইভি পরীক্ষার সময় এসেছে’

“কক্সবাজারে এইডস উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মন্তব্য করে জেলার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আশিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “এখন গণহারে এইচআইভি পরীক্ষা করার সময় এসেছে।”

হাসপাতালে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা এবং ঔষধসহ সব সেবা দেওয়া হয় জানিয়ে ডা. আশিক বলেন, “এইডস আক্রান্ত হবার পর মূলত: কাউন্সেলিংই প্রধান চিকিৎসা।”

“এইচআইভি পজিটিভ হবার পর অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এ সময় মনোবল শক্ত করার জন্য এবং তাদের জীবনাচরণ কেমন হওয়া উচিৎ এসব বিষয়ে কাউন্সেলিং করা হয়,” বলেন তিনি।

বর্তমানে আক্রান্তদের মধ্যে ৭২৬ জন চিকিৎসার আওতায় আছেন। এর মধ্যে ৫০৭ জনকে সদর হাসপাতালে আর ২১৯ জনকে উখিয়া হেলথ কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান ডা. আশিক।

ডা. আশিক বলেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য ‘প্রিভেনশন মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন’ (পিএমসিটি) নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে এইচআইভি পজিটিভ গর্ভবতী মায়ের গর্ভের সন্তান যেন এইচআইভি নেগেটিভ হয়, সেজন্য সেবা দেওয়া হচ্ছে।

প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি

গত বৃহস্পতিবার উখিয়ার জামতলী ১৫ নম্বর শিবিরের এইচ ব্লকের মো. ইসমাইল তাঁর চার বছরের এইডস আক্রান্ত কন্যা শিশুকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসেন।

ইসমাইল বেনারকে বলেন, “শিশুর ওজন কমে যাচ্ছিল; জ্বর, ডায়রিয়া লেগেই ছিল। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলে এইডস পরীক্ষা করাতে বলেন, এরপর এইচআইভি ধরা পড়ে।”

সন্তান কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে বিষয়টি বুঝতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, মেয়েকে ডাক্তার ঔষধ দিয়েছে। আর বলেছে ১৪ দিন পর পরিবারের সবাইকে এইডস পরীক্ষা করাতে।

“রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা হাসপাতালে সেবা নিতে আসছে, তাদের কেইস স্টাডি করে জানতে পারছি, তাদের অনেকেই শরীরে এইচআইভি ভাইরাস বহন করছে, কিন্তু টেস্টের আওতায় আসেনি। এ অবস্থায় শিবিরগুলোতে ব্লক ভিত্তিক টেস্ট করানো হলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বাড়বে বলে ধারনা করা যায়,” বলেন ডা. আশিক।

রোহিঙ্গা শিবিরে এইডস এর ভয়াবহ বিস্তার রোধে দ্রুত ব্যাপকহারে এইচআইভি শনাক্তকরণের উদ্যোগ নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমে শনাক্তকরণ, এরপর চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”

স্থানীয়দের উদ্বেগ বাড়ছে

রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের মধ্যেও এ রোগ ব্যাপক হারে ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে ডা. আশিক জানান, গত বছরের জুলাই থেকে এ বছর জুন পর্যন্ত এক বছরে ১ হাজার ৩৪২ জনের এইচআইভি টেস্ট করা হয়। এদের মধ্যে ১২৯ জন এইচআইভি পজিটিভ রোগী পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ১১৯ জন রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গারা এখন ক্যাম্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই জানিয়ে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বেনারকে বলেন, “কক্সবাজার পর্যটন এলাকা, এখানকার অনেক হোটেল মোটেল বা স্পা সেন্টারে রোহিঙ্গা নারীরা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে স্থানীয়দের মধ্যেও এইডস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগে এবং পরে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন প্রায় ১১ লাখ। তারা কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের ৩৪টি অস্থায়ী আশ্রয় শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে অবস্থান করছেন।

এইডস প্রতিরোধে উদ্যোগ

কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মাহবুব জানান, এইডস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিভাগের নানা প্রচার, কাউন্সেলিং ছাড়াও সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এখন এইডস সচেতনতায় কাজ করছে। সম্প্রতি টুরিস্ট পুলিশও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

তিনি বেনারকে বলেন, “কক্সবাজার সদর হাসপাতাল এবং উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও সদর হাসপাতালে এন্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টার আছে, যেখানে এইডস রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং করা হয়। 

রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের এইডস-এ আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ছে জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, হাসপাতালে সাধারণ চিকিৎসা নিতে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কারও লক্ষণ আছে মনে হলেই, তাদের এইচআইভি পরীক্ষা করা হচ্ছে।

কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “বর্তমানে কক্সবাজারে এইডস-এর যে বিস্তার দেখা দিয়েছে, তা উদ্বেগজনক এবং পর্যটনের জন্য বড়ো হুমকি।”

“এখানকার হোটেল মোটেলসহ স্পা সেন্টারগুলোতে অসামাজিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্পা সেন্টারে কর্মী নিয়োগের সময় এবং প্রতি তিন মাস পর পর এইচআইভি টেস্ট করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে,” বলেন তিনি।

আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে সব স্পা সেন্টারের কর্মীদের বিস্তারিত তথ্য টুরিস্ট পুলিশ অফিসে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান রেজাউল করিম।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে এইডস সংক্রমিত হয়েছেন ১৪ হাজার মানুষ। আক্রান্তদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ রোগী চিকিৎসার আওতায় আছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।