নতুন করে আবারো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2017.08.24
ঢাকা ও কক্সবাজার
টেকনাফের লেদা বস্তির এক বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ছেনোয়ারা। টেকনাফের লেদা বস্তির এক বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ছেনোয়ারা। আগস্ট ২৪, ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

সীমান্তে কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে আবারও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত আনান কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি এড়িয়ে শান্তি ফেরাতে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

চলতি মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা মোতায়েনের পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রায় সাত হাজার নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)।

গতকাল প্রকাশিত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিতে বলা হয়। ‘রাখাইনের জনগোষ্ঠীর জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, নায্য ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন নিয়ে কফি আনান গতকাল বিকেলে ইয়াঙ্গুনে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে বুধবার তিনি প্রতিবেদনের একটি কপি দেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট তিন কিউর কাছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সমীক্ষা

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার নতুন হিসাব বলছে, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রায় সাত হাজার নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। যদিও আইওএম’র কক্সবাজার সাব-অফিসের প্রধান সংযুক্তা সাহানি বেনারকে নতুন প্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা কত তা “এখন বলা যাচ্ছে না” বলে জানান।

তবে গত অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৮৭ হাজারেরও বেশি বলে সংস্থাটির সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়।

এতে জানানো হয়, এ বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কিছুটা কমে আসে। সে পর্যন্ত নতুন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৮০ হাজার ধরা হয়। তবে জুলাই থেকেই অনুপ্রবেশ আবারও বাড়তে শুরু করে। আইওম’র সমীক্ষায় বাকি সাত হাজার জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রবেশ করেছে বলে ধরা হচ্ছে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আইওএম বাংলাদেশ দপ্তর কক্সবাজারে অবস্থান করা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মানবিক প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সমীক্ষা শুরু করে। সেই সমীক্ষার হালনাগাদ তথ্য জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয় দপ্তরের বিশেষায়িত ডিজিটাল সেবা রিলিফওয়েব মঙ্গলবার তাঁদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন সীমান্তের তিনটি চেকপোস্টে হারকাত আল-ইয়কিন (বর্তমানে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামে পরিচিত) অস্ত্রধারীদের হামলায় নয়জন সীমান্তরক্ষী নিহত হওয়ার পর সেনা অভিযান শুরু করে দেশটি। এরপর থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

সীমান্তে দুই পক্ষের নজরদারি

এদিকে মিয়ানমারের নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়িয়েছে।

কোস্টগার্ড চট্টগ্রাম অঞ্চলের অপারেশন কর্মকর্তা লে. ফখর উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, “নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকার খবর শুনে টহল আরও বেশি জোরদার করা হয়েছে। এ মাসেই অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ৪৫ জন রোহিঙ্গার প্রবেশ ঠেকানো হয়েছে।”

টেকনাফের বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আগস্ট মাসেই নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে শূন্যরেখা অতিক্রম করে অনুপ্রবেশকালে ২৪ জন রোহিঙ্গাকে ঠেকানো হয়েছে। এর আগে গত জুলাই মাসে ২০৪ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়।”

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক। যিনি বুধবার সকালে উখিয়া ও টেকনাফের কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের কারণে মাদক পাচার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, জন নিরাপত্তার মতো সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের কাজও চলছে।”

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলেও বেনারকে জানান শহীদুল হক।

মুখে মুখে নির্যাতনের বর্ণনা

নতুন আসা এসব রোহিঙ্গাদের মুখেও নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা। মিয়ানমার সেনারা গ্রামের পর গ্রাম অবরোধ করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁদের।

পাঁচ সন্তান নিয়ে স্বামী শামসুল আলমের সঙ্গে এসে টেকনাফের লেদা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন রাখাইন রাজ্যের উধং’র বাসিন্দা সেতারা বেগম (৪০)।

তিনি বেনারকে জানান, গত ১২ আগস্টের শেষরাতে উধং’য়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আক্রমণ করে। প্রাণ বাঁচাতে তাঁর স্বামী পালালেও সেনারা বাড়িতে ঢুকে সবাইকে বন্দী করে নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে সেনারা তার চাচাতো ভাই মো. জুবাইকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর কপালে কী ঘটেছে সেতারা জানেন না।

তিনি বলেন, “সেনারা পাশের গ্রামের শিশুসহ প্রায় ৪০ জনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদেরও কোনো হদিস মেলেনি। প্রাণের ভয়ে শেষ পর্যন্ত আরো ২০ জনের সঙ্গে গত শনিবার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসি।”

এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী তিন সন্তানের মা ছানোয়ারা বেগম বেনারকে জানান, মিয়ানমারের সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে তার স্বামী ছলিম উল্লাহকে ঘরে আটকে চার পাশে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যায়। কোনোরকমে স্বামীকে উদ্ধার করে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পেরেছি।

কিন্তু এখানে এসে অন্যদের কাছ থেকে ভিক্ষা করে চলতে হচ্ছে বলে জানান মংডুর মাংঘালা গ্রামের এই নারী।

উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা বস্তির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক বেনারকে বলেন, “গত কয়েক দিনে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রায় ১৫০ জন রোহিঙ্গা এসেছে। ওপারে সেনারা আবারও নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অনুপ্রবেশকারীদের মুখে শুনেছি।”

আনান কমিশনের প্রতিবেদন

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে তাদের নাগরিক অধিকার দেওয়ার পথ সুগম করতে মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন প্রদেশের পরামর্শমূলক কমিশন।

এসব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হলে রোহিঙ্গা এবং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী উভয়েই কট্টরপন্থার পথে ধাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। কমিশন মনে করে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট কৌশল ও সময়সীমা ঠিক করতে হবে, যা হবে স্বচ্ছ ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আনান কমিশন ৮৮টি সুপারিশ করেছে। সেখানে রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা, লোকজনের অবাধ চলাচল ও নাগরিকত্ব আইনের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্ম, বর্ণ কিংবা নাগরিকত্ব নির্বিশেষে রাখাইন রাজ্যের সকল জনগোষ্ঠীকে অবাধে চলাচলের সুযোগ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইনের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন ও সহিংসতা চালাচ্ছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৬ সালে এই কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সদস্য ঘাসান সালামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এ বছর বাংলাদেশ সফর করেছিল।

প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশহীন সম্প্রদায় বলে বর্ণনা করেছে আনান কমিশন। এতে মিয়ানমারকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পরামর্শও দেওয়া হয়।

আনান কমিশনের প্রতিবেদনকে ‘মাইলফলক’ উল্লেখ করে এটি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার।

প্রসঙ্গত সাধারণভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তবে আনান কমিশনের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের শুধু ‘মুসলিম’ অথবা ‘রাখাইনের মুসলিম সম্প্রদায়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয় “স্টেট কাউন্সেলর এর (আং সান সু চি) অনুরোধে ‘বাঙালি’ অথবা ‘রোহিঙ্গা’ কোনোটি ব্যবহার না করে তাঁদেরকে (রোহিঙ্গা) ‘মুসলিম’ অথবা ‘রাখাইনের মুসলিম সম্প্রদায়’ বলে কমিশন উল্লেখ করেছে।

মিয়ানমার সফরে যাবেন পোপ

এ বছরের শেষে পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার ও বাংলাদেশ পরিদর্শন করবেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এটাই হবে কোনো পোপের প্রথম মিয়ানমার সফর।

নভেম্বরের শেষের দিকে কিংবা ডিসেম্বরের শুরুতে, সম্ভবত ক্রিসমাসের আগে এ সফর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রে জানিয়েছে রয়টার্স। এসময় তিনি বাংলাদেশও সফর করবেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সৃষ্ট বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একইসঙ্গে পোপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।