রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর: প্রত্যাবাসনের আগে নাগরিকত্ব ও অপরাধের বিচার দাবি

শরীফ খিয়াম
2018.08.24
কক্সবাজার
180824_Rohingya_one_year_1000.jpg মোহাম্মদ জাকারিয়া (৭০), গত বছরের ২৫ আগস্ট মংডুর চালিপাড়া থেকে পরিবারের নয় সদস্য নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা করছিলেন। ২৪ আগস্ট ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের মাঝি মো. ফয়েজু আরাকানি। গেল বছর এই সময়ে যখন মংডুর বাসভূমি ছেড়ে তিনি বাংলাদেশের দিকে ছুটছেন, তখন চারদিকে রক্তের বন্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে, নারী-শিশুদের অবস্থা অবর্ণনীয়।

আজ যখন দেশে ফেরার কথা উঠছে, তখনো তাঁর চোখে মুখে ভয় আর অস্বস্তি। ফয়েজুর মতো একই অবস্থা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আরও লাখ লাখ রোহিঙ্গার।

গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা চেকপোস্টে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এরপরই মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাসপোর্ট ও বহিরাগমন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এসব ক্যাম্পে এ পর্যন্ত ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছেন। তবে ইউএনএইচসিআর বলছে, গত ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আট লাখ ৯১ হাজার ২শ ৩৩ রোহিঙ্গার পরিসংখ্যান আছে।

এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা চললেও তাঁরা ফিরতে চান না। তাঁদের এই অনিচ্ছার কারণ কী? গত সোমবারই মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি বলেছেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এখন নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশ ফেরত পাঠালেই মিয়ানমার তাঁদের স্বাগত জানাবে।

গত তিন দিন ধরে উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থীশিবিরের প্রায় অর্ধশত রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা হয়।

কথা হচ্ছিল মংডুর চর নাপ্পির আদি বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে। চর নাপ্পির সাবেক ওই জনপ্রতিনিধি বলছিলেন অং সাং সু চি কথা বলছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভাষায়। তাঁরা তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

“সব ক্ষমতা আসলে সেনাবাহিনীর হাতে। সু চি ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গারা নাগরিক অধিকার ফিরে পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে,” মোহাম্মদ হোসেন বলেন।

তারপরও রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে চান। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশে তাঁরা থাকতে আসেননি। নাগরিকত্বের বিষয়টি ফয়সালা হলে তাঁরা ফিরে যাবেন। সেই সাথে তাঁদের দাবি অপরাধীদের যেন বিচার হয়।

সু চি মুখে তো বললেন, মিয়ানমার স্বাগত জানাবে। কিন্তু প্রস্তুতি কোথায়—এমন প্রশ্ন শরণার্থীদের।

কুতুপালং শরণার্থীশিবিরের মো. ফয়েজু আরাকানি বেনারকে বলেন, “আমরা কি আমাদের অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারব? আমরা আশা করি, সে নিশ্চয়তা না পেলে বাংলাদেশ আমাদের ফেরত পাঠাবে না। তবুও যদি জোর করা হয়, এই দেশের সরকারকে আমরা বলব, বরং তোমরাই আমাদের মেরে ফেলো।”

একই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে, মংডুর দুম চাপাড়া থেকে পালিয়ে আসা ৩৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ হোসেন, বুথিডং এর তেজিঙ্গাপাড়ার এহসানুল হক, মংডুর উত্তরে চালিপাড়ার আদি বাসিন্দা সৈয়দ ইসলামের কাছ থেকেও।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কতটা আন্তরিক মিয়ানমার? কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্ট এশিয়া সেন্টার এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে।

“ফিরিয়ে নেওয়ার যেসব প্রতিশ্রুতি তারা দিচ্ছে এগুলো মূলত কাগজে-কলমে। সামরিক জান্তারা যেই ভাষায় কথা বলে, অং সান সুচি এখানে সেই ভাষায় কথা বলেছেন। বাস্তবে তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না,” ড. দেলোয়ার হোসেন বলছিলেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও সফর এবং বহু পাক্ষিক আলোচনার পরও যত দূর জানা যাচ্ছে দেশটিতে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

গত ৯ থেকে ১২ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল প্রথমে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো ও পরে রাখাইন সফর করে। ফিরে এসে প্রতিনিধিদলটি জানায়, এখনো সেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

আর শরণার্থীশিবিরের মানুষ অদৃষ্টের হাতে সব ছেড়ে দিয়েছেন। এক বছর পূর্তিতে, শনিবার শিবিরগুলোয় বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। আগামী ২৫ আগস্টের আগেই যেন সব সমস্যার সমাধান হয় সেই প্রার্থনা করবেন তাঁরা।

কোথায় থেমে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট খুব কাছ থেকে যাঁরা দেখছেন, সেসব বিশ্লেষকেরা বলছেন আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। গত ২৫ আগস্টের পর দফায় দফায় প্রভাবশালী পক্ষগুলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংক প্রধান জিম জং কিম গত ১ জুলাই তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তারও আগে এপ্রিলের শেষ ভাগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল চার দিনের সফরে আসেন। তাঁরা রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানায়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীন ও ভারতের সমর্থনের কারণে আসলে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ পর্যন্ত করেনি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে লজ্জার মাইলফলক রচিত হয়েছে। আর এ জন্য তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছে।

দেলোয়ার হোসেন বলছিলেন, শরণার্থীদের নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে চীন বা রাশিয়াকে সংযুক্ত করতে হবে।

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গারা, স্বাস্থ্যঝুঁকি

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচআরসির মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, ইস্যুটির শুরুই হয়েছে ‘ভায়োলেন্স’ দিয়ে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা এখনো ট্রমায় আক্রান্ত।

তিনি বলেন, “যেসব রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে এখানে পালিয়ে এসেছে, তাদের অনেকেই চোখের সামনে নিজের পরিবারের সদস্যদের খুন হতে দেখেছেন। এই ট্রমা সহজে কাটবে বলেও মনে হচ্ছে না।”

এদিকে মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার্স শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানায়, অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তৈরি ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবনযাপনসহ নানা কারণে এখনো রোহিঙ্গাদের জীবন ভোগান্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বেড়াজালে আটকে রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।