উত্তপ্ত রাখাইন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর বাংলাদেশ

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2017.08.25
ঢাকা ও কক্সবাজার
উখিয়ার একটি খাল পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার একটি খাল পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। ২৫ আগস্ট ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে আবার হামলার জেরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এদের অনেককেই আটক করে ফেরত পাঠাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি।

“বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে দলে-দলে রোহিঙ্গারা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ১৪৬ জন মিয়ানমার নাগরিককে আটক করে বিজিবি। পরে তাদের মানবিক সহযোগিতা দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে,” বেনারকে জানান টেকনাফ ২ বিজিবির উপ-অধিনায়ক সরিফুল ইসলাম জোমাদ্দার।

এদিকে রোহিঙ্গা প্রবেশের ঘটনায় মিয়ানমার সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। গত কয়েক দশক ধরে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও এবার আর তা হবে না বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক।

শুক্রবার তিনি বেনারকে বলেন, “মনে হচ্ছে না আমরা এবার আর আশ্রয় দেবো। বারবার এভাবে চলতে পারে না। আমরা মিয়ানমারকে কড়া প্রতিবাদও জানিয়েছি।”

বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইন রাজ্যের ২৪টি পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৭১জন নিহত হয়েছেন বলে শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।

রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই হামলার ঘটনা ঘটল।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমরা মিয়ানমারে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আশা করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে শুধু সহিংসতাই দেখতে পাচ্ছি। মিয়ানমারের এই সহিংসতায় বাংলাদেশ আবারো ভুক্তভোগীতে পরিণত হবে।”

ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা বড়ো রকমের আর্থ-সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আরো নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করবে।”

“আমরা মিয়ানমার সরকারকে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ জানাই। সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে, সামরিকভাবে নয়,” বেনারকে বলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

টেকনাফ উপজেলার উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে বিজিবির হাতে আটক রোহিঙ্গারা। ২৫ আগস্ট ২০১৭
টেকনাফ উপজেলার উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে বিজিবির হাতে আটক রোহিঙ্গারা। ২৫ আগস্ট ২০১৭
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

একদিনেই সহস্রাধিক রোহিঙ্গার প্রবেশ

স্থানীয় লোকজন ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, গত এক দিনেই প্রায় ১১’শ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়া অনুপ্রবেশের জন্য শত শত রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে ওপারের সীমান্তে অপেক্ষা করছেন বলে জানিয়েছেন প্রবেশকারীরা।

লেদা ক্যাম্পের মো আমিন বলেন, লেদা ক্যাম্পে ২৫০ জন ও মৌচনী ক্যাম্পে ১৫০ জন নতুন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

উখিয়ার আরেক রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “উখিয়া সীমান্ত দিয়ে ঢুকে বালুখালীর নতুন বস্তিতে প্রায় ৫ শতাধিক ও রহমতবিল এলাকায় ২ শতাধিক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে বেশিভাগ নারী ও শিশু।”

শুক্রবার ভোরে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা মো. জুবাইর বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে হঠাৎ করে মিয়ানমার সেনারা আবারও আগের মতোই রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে সেনা ও রাখাইন লোকজন।

“জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আসার জন্য শত শত রোহিঙ্গা ওপারের সীমান্তে অপেক্ষা করছে। এপারে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের কড়া নজরদারি থাকায়, তারা ঢুকতে না পেরে সেখানে অবস্থান নিয়েছে,” বলেন তিনি।

নিজে প্রায় তিন ঘণ্টা নাফনদীতে ভাসমান থাকার পরে আরও ২৫ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে প্রবেশ করেছেন বলে জানান জুবাইর। তাদের সকলের বাড়ি মংডু মেরুল্লা, হাছসুরাতা ও কুল্লান গ্রামে।

অনুপ্রবেশকারীরা জানান, রাখাইনের বতছড়া, আনডাং, কুল্লান, শীতা, মেরুল্লা, হাসসুরাতা, পতেঙ্গা, কেয়ারি পালং, সিতাপ্রু, শিলখালী, ডুংচা পাড়াসহ প্রায় ২০ গ্রামে হামলা চালানো হয়েছে।

২৪টি পুলিশ পোস্টে হামলা

রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে সমন্বিত এই হামলার সূত্রপাত হয় বলে শুক্রবার মিয়ানমার সরকারের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

এতে একজন সামরিক বাহিনীর সদস্য, দশজন পুলিশ, এক পৌর কর্মকর্তা ও ৫৯ সন্ত্রাসী নিহত হন বলে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচির কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়।

আক্রমণে আহত এগারো জনের মধ্যে তিন জনের অবস্থা গুরুতর এবং ওই ঘটনায় একজন ‘সন্ত্রাসী’কে গ্রেফতারের কথাও বিবৃতিতে জানানো হয়।

তবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচির কার্যালয়ের বিবৃতিতে হামলাকারীদের বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এদিকে শুক্রবার এ হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)’ নামে একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপ। এক সময় এই গ্রুপটি ‘হারাকা আল-ইয়াকিন’ নামে পরিচিত ছিল। যারা গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনের পুলিশ পোস্টে হামলা চালায়। ওই হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হয়।

শুক্রবার এআরএসএ এর নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে শুক্রবার হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়, ২৫টির বেশি জায়গায় বার্মিজ নির্যাতনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কার্যক্রম চালানো হয়েছে। শিগগির আরও আসছে।

গত ১৬ আগস্ট ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে সতর্ক করেছে বিদ্রোহী সংগঠন এআরএসএ। অন্যথায় রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন এআরএসএ নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মা জুনুনি। এর মাত্র নয়দিনের মাথায় এই হামলা চালাল তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ বরাবরই এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার বিপক্ষে। এ ঘটনারও নিন্দা জানাচ্ছি।”

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এআরএসএ সম্পর্কে কমবেশি তো আমরা জানি। এটা আগে আরএসও, হারকাত আল-ইয়াকিন নামে ছিল। মিডিয়ায় দেখেছি ওরা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামে নতুন নাম দিয়েছে।

কোনো এআরএসএ সদস্য বাংলাদেশে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের পলিসি তাঁদেরকে আশ্রয় দেওয়া নয়।”

প্রসঙ্গত গত অক্টোবরে সীমান্ত রক্ষীদের চৌকিতে হামলার পরেই রাখাইনের গ্রামে গ্রামে অভিযান চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী অভিযোগ তোলে জাতিসংঘ।

সেনা অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা। গত কয়েক দশকে ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি সরকারের। তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে এখনো কাঙ্ক্ষিত সাড়া দেয়নি দেশটি।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে পুলক ঘটক

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।