মিয়ানমারে যুদ্ধ করতে কিশোরদের অপহরণ, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আতঙ্ক
2024.08.29
ছবির ছেলেটিকে গম্ভীর, ধার্মিক এবং খুব অল্প বয়স্ক দেখাচ্ছে।
মুহাম্মদ তার ছোট ভাই ফরহাদের এই ছবিটির দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকেন। তাঁর কাছে থাকা কয়েকটি ছবির মধ্যে এটি একটি। মাত্র ১৩ বছর বয়সের তাঁর ভাই কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ।
গত মে মাসে কক্সবাজারের বালুখালী শরণার্থী শিবিরের ভেতরে অবস্থিত স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় ফরহাদকে অপহরণ করা হয়।
[নিরাপত্তার কারণে এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত শরণার্থীদের নামগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে।]
ফরহাদ এবং তার চার ভাই মিয়ানমারে রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযান থেকে পালিয়ে আসার পর ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের এই ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন।
“আমি শুধু তার ভাই নই। আমি তার পিতার মতো; সে আমার সন্তানতুল্য," গত জুন মাসে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন ২৬ বছর বয়সী মুহাম্মদ।
ফরহাদ নিখোঁজ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে মুহাম্মদ কয়েকটি ফোন কলের সূত্র ধরে তাঁর ভাইর গতিবিধি সন্ধান করেছেন। কিন্তু এতে উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন জমা হয়েছে বেশি।
ফরহাদকে কারা অপহরণ করেছে, তা মোহাম্মদ জানতে না পারলেও কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরটি বিভিন্ন গ্যাংয়ের দখলে রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অপহরণ করছে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান যুদ্ধে লড়াই করার জন্য পাচার করছে।
অন্যান্য ধরনের সহিংসতার পাশাপাশি অপহরণের ঘটনা শিবিরগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে জর্জরিত করছে। পুরুষ ও নারীদের শ্রম বা যৌন কাজের জন্য পাচার করা হয়। নেতাদের অপহরণ করা হয় রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কাজে তাদের সমর্থনের জন্য শাস্তি হিসাবে। কখনও কখনও পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্যও উদ্বাস্তুদের অপহরণ করা হয়।
কিন্তু এই বছরের শুরু থেকে অপহরণের একটি ভিন্ন রূপ সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার রাখাইন রাজ্যে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতির মুখে ফেব্রুয়ারিতে একটি দীর্ঘ-সুপ্ত সেনা নিয়োগ আইন প্রয়োগের ঘোষণা করেছে। বলপূর্বক সেনা নিয়োগের এই প্রচেষ্টা শুধু মিয়ানমারের সীমানার মধ্যে থেমে নেই। নিযুক্ত বিভিন্ন অপরাধী চক্র সামরিক বাহিনী এবং এমনকি তাদের বিরোধী শক্তির যুদ্ধে মানুষ সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আটক বিপুল জনসংখ্যাকে ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে মনে হচ্ছে।
ফরহাদ মুহাম্মদকে মোবাইল ফোনে বলেছিলেন, তাকে রাখাইন রাজ্যে পাচার করা হয়েছে এবং দক্ষিণে বুথিডাংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে তাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। জান্তা সেনারা তাকে প্রায় ৪০ জন রোহিঙ্গা যুবক ও বালকের সাথে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে রাখে। প্রথম দুই সপ্তাহের জন্য ফরহাদকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাকে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ থেকে প্রত্যাহার করে সৈন্যদের জন্য রান্না এবং অন্যান্য ফাইফরমাশের কাজে সহায়তার কাজে লাগানো হয়েছে।
ইউনাইটেড স্টেটস ইন্সটিটিউট অফ পিস-এর জন্য একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন জেসিকা ওলনি। অনেক বছর থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা এই স্বাধীন বিশ্লেষক আরএফএ-কে বলেছেন, “মিয়ানমারের ভেতরে ও শরণার্থী শিবিরে অপহরণ এবং জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে যোগদান একটি ঘোরতর মারাত্মক ব্যাপার হয়ে গেছে। এমনিতেই ভয়ঙ্কর খারাপ অবস্থায় থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য এ এক অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে উঠেছে ... এখানে পরিস্থিতি আবার খারাপ হচ্ছে।”
ফরহাদের মতো অপহরণ ঘটনাগুলো শরণার্থী শিবিরে জীবনযাত্রার রূপ পরিবর্তন করেছে। গভীরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্ত্রাস আতঙ্কের একটি নতুন রূপের জন্ম দিয়েছে। দোকানপাট ও ঘরবাড়ির দরজা বন্ধ থাকছে। যে রাস্তাগুলোতে একসময় শিশুদের খেলাধুলা আর যুবক-যুবতীর ভিড় ছিল সেগুলো এখন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বহিরাগত কাউকে দেখলেই রোহিঙ্গাদের চেহারায় অবিশ্বাসের চাহনি ফুটে ওঠে। অনেক পরিবার তাদের ছেলে, ভাই-ভাতিজাদের লুকিয়ে রেখেছে।
মুহাম্মদ বলেছেন, ফরহাদ অপহরণ হওয়ার পর থেকে তার সহপাঠীরা পরবর্তী শিকার হওয়ার ভয়ে বাস করছে। “অধিকাংশ ছাত্র ভীত সন্ত্রস্ত," উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তবে এটি এখন এক ধরনের নতুন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।”
‘আমাদের লোকেরাই এখন আমাদের নির্যাতন করে’
জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের আদি নিবাস মিয়ানমারে সহিংসতা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়ে আসছে। যেখানে তারা আইনত নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নয়। লাখ লাখ নির্যাতিত মানুষ বাঁচার জন্য পালিয়ে এসে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও রক্তপাত চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সেসময় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার অভিযানের কারণে সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং অন্যান্যরা এই আক্রমণগুলোকে গণহত্যা হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে।
বর্তমানে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এই ঘিঞ্জি শিবিরে বাস করে যেখানে মুহাম্মদ এবং তার পরিবারের ঠাঁই হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এখনও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে দেখে এবং ক্যাম্পের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি করুণ।
ভূমিধ্বস ও অগ্নিকাণ্ডে নিয়মিত মানুষ মারা যায়। পয়ঃনিষ্কাশন এবং সুপেয় পানির অভাবে কলেরা এবং অন্যান্য রোগে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা স্বাভাবিক। শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন। পর্যাপ্ত খাবার নেই এবং প্রায় কাউকেই আইনত চাকরি করার অনুমতি দেওয়া হয় না।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সংকট। মাদক, মানব পাচার এবং চাঁদাবাজির মতোই অপহরণ ও অগ্নিসংযোগ সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্তৃত্বের লড়াইয়ে কমপক্ষে ৯০ জন নিহত হয়েছে।
তারপরও কক্সবাজার ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এ অবিশ্রান্তভাবে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা স্রোতধারার। পর্যবেক্ষকদের মতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান যুদ্ধ আরেকটি গণহত্যার দিকে যেতে পারে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল চলতি মাসে সর্বশেষ হামলাগুলোর বিষয়ে সতর্ক করেছে, যেসব ঘটনায় পলায়নপর বেসামরিক লোকদের ওপর বোমা মারা হয়েছিল। এসব ঘটনা “২০১৭ সালের আগস্টের নৃশংসতার সাথে ভয়ঙ্কর সাদৃশ্য বহন করে," বলেছে অ্যামনেস্টি।
পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদেরকে অপরাধীদের কাছে দ্বিগুণ দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসছে তাদের কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই চোরাকারবারিদের টাকা দিতে হয়।
অন্যদিকে যারা শরণার্থী শিবির ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রার মাধ্যমে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের কাছ থেকে পাচারকারীরা আদায় করছে লাখ লাখ টাকা। প্রায়শই পাচারকারীরা শিবির নিয়ন্ত্রণকারী অপরাধী চক্রগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখে।
এই গোষ্ঠীগুলি জান্তা এবং তার বিরোধী শক্তি উভয়ের জন্য যোদ্ধা ও সহকারী হিসাবে কাজ করার জন্য যুবক ও বালকদের অপহরণ করে। মুক্তিপণের বিনিময়ে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া তাদের আয়ের আরেকটি উৎস হয়ে উঠেছে বলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আরএফএ-কে জানিয়েছেন।
ক্যাম্পে বসবাসকারী আরেক শরণার্থী মোস্তফা প্রায়ই তার আত্মীয়ের চায়ের দোকানে যেতেন। তিনি এবং তার বন্ধুরা সেখানে বসে তাদের বিপর্যস্ত জীবনের গল্পগুজব করে কিছুটা সুন্দর সময় কাটাতেন।
“এখন আর তা সম্ভব নয়,” জুন মাসে আরএফএ-কে বলেছিলেন তিনি। এক সপ্তাহ আগে মোস্তফা সেখানে বসেছিলেন, যখন একদল সশস্ত্র লোক দোকানের ঠিক বাইরে দুই যুবককে ধরে ফেলে। অপহরণকারীরা আরাকান আর্মির (এএ) সদস্য। এএ প্রধানত বৌদ্ধদের একটি সশস্ত্র সংগঠন, যারা রাখাইনে স্ব-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছে।
অপহরণের দৃশ্য দেখার পর কয়েকদিন পার হলেও মোস্তফা এখনো ভয়ে কেঁপে ওঠেন।
“কখনও কখনও ক্যাম্প প্রশাসন পুলিশ পাঠায়, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তারা তা করে না,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “শিবিরে বসবাস করা এখন খুব কঠিন। আমরা [মিয়ানমারে] বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত হয়েছিলাম। আর এখন আমাদের নিজেদের লোকেরাই আমাদের ওপর নির্যাতন চালায়।”
ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অসংখ্য সশস্ত্র দল কাজ করলেও তাদের মধ্যে প্রধান হলো আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। বিশ্লেষক এবং উদ্বাস্তুরা একইভাবে বলছেন, স্বল্প পরিচিত আরাকান রোহিঙ্গা আর্মিসহ নিয়োগকৃত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অপহরণের জন্য দায়ী।
আরসা রাখাইনে ২০১৭ সালের আগস্টে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি এবং সেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে প্রথমবার ব্যাপকভাবে নজরে আসে। সেসময় তারা মিয়ানমার সরকারের কমপক্ষে ১২ জন সীমান্তরক্ষীকে হত্যা করেছিল, যার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনারা পরবর্তীতে নৃশংস দমন অভিযান শুরু করেছিল। জঙ্গি গোষ্ঠীটি পরবর্তী মাস এবং বছরগুলোতে আরো কিছু ঘটনার মাধ্যমে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, হিন্দু গ্রামে সহিংস আক্রমণ চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করা।
২০১৯ সাল নাগাদ জঙ্গিরা শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে অপরাধমূলক কার্যকলাপের দিকে তাদের মনোযোগ দেয়। সে সময় মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটসের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আরসা তার সমালোচকদের অপহরণ, আটক ও নির্যাতন শুরু করেছে।
চার দশক ধরে বিদ্যমান আরএসও কক্সবাজারের ভেতরে একই ধরনের অভিযান চালিয়েছে।
দলে নিয়োগের জন্য অপহরণের ক্ষেত্রে জঙ্গি দলটি নাবালকদের পেছনে লেগেছে বলে মনে হয়। “আমরা লক্ষ্য করেছি আরএসও জবরদস্তি করছে এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশে চাপ সৃষ্টির কৌশল নিচ্ছে," বলেছেন ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি তৃতীয়। “বাচ্চাদের জোরপূর্বক নিয়োগের কিছু ঘটনা ছিল,” উল্লেখ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক আইনে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়োগ করা বা যুদ্ধে পাঠানো বেআইনি, যদিও মিয়ানমারসহ বেশিরভাগ দেশ দ্বারা অনুমোদিত একটি ঐচ্ছিক শিশু অধিকার প্রোটোকল অনুযায়ী ন্যূনতম বয়স ১৮। আরসা এবং আরএসও’র মতো রাষ্ট্র-বহির্ভূত সংগঠনগুলোর জন্য যে কোনো বয়সের সাধারণ নাগরিককে নিয়োগ করা বেআইনি।
সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো কীভাবে শিবির থেকে শরণার্থীদের অপহরণ করে এবং তাদেরকে জান্তার হাতে তুলে দেয় সে বিষয়ে বর্ণনা দিয়ে ফোরটিফাই রাইটস জুলাই মাসে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেসব শরণার্থীকে অপহরণ করা হয়েছিল এবং পরে পালিয়ে গিয়েছিল তারা ফোর্টিফাই রাইটসকে একটি বাজার বা ক্যাফেতে ধরা পড়ার কথা বলেছিল। সীমান্ত পেরিয়ে এনে তাদেরকে সৈন্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। একজন বলেছেন, তার পরিবার এক লাখ টাকা দেওয়ার পরেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
‘আমাদের জন্য কোনো নিরাপদ জায়গা নেই’
অপহরণের হুমকির কারণে পরিবারগুলো মরিয়া হয়ে তাদের ছেলেদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কক্সবাজারজুড়ে নিরাপত্তা সংকটের কারণে তা প্রায় অসম্ভব।
মে মাসের মাঝামাঝি দামিরা তার ২২ বছর বয়সী ছেলেকে প্রতিবেশী শরণার্থী শিবিরে আত্মীয়দের কাছে থাকতে পাঠায়। পরিবারটি সম্প্রতি মিয়ানমারের মংডুতে সহিংসতার কারণে পালিয়ে এসেছে। সেখানে তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আত্মীয়দের হত্যা করেছে। কিন্তু কক্সবাজারের অভ্যন্তরে তাদের নতুন বাড়িটিও তাদেরকে নিরাপত্তার তেমন কোনো অনুভব দিচ্ছে না।
গত জুন মাসে দামিরা আরএফএকে বলেছেন, “বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমারের ভেতরে ভয় কম ছিল। আমরা কখনই ভাবিনি আমাদের ছেলেকে এখানে লুকিয়ে রাখতে হবে।"
অতি সামান্য সংখ্যক পুলিশের দেয়া নিরাপত্তায় চালিত বিশাল ক্যাম্পের মধ্যে প্রায় কোথাও কোন সুরক্ষিত স্থান নেই। কুইনলি বলেন, শরণার্থীদের চলাচলের স্বাধীনতার ওপর বাংলাদেশের কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে সেখান থেকে চলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
“জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা হুমকির সম্মুখীন যে কাউকে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে স্থানান্তর করতে পারে। কিন্তু “সমস্ত শিবিরের চারপাশে আরএসওর প্রচুর উপস্থিতি রয়েছে," বলেন তিনি।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করার জন্য ক্যাম্প থেকে কত শিশু বা প্রাপ্তবয়স্কদের অপহরণ করা হয়েছে তা জানা অসম্ভব। জাতিসংঘের একটি গোপনীয় প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এএফপি জানিয়েছে, মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ রোহিঙ্গাকে ক্যাম্প থেকে জোরপূর্বক যোগদান করানো হয়েছে। একজন স্থানীয় সাহায্য কর্মী আরএফএকে বলেছেন, তার ধারণা অন্তত তিন হাজার মানুষ অপহরণ করা হয়েছে। তবে বেশ কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী এবং বিশ্লেষক স্বীকার করেছেন, কতজন শরণার্থী যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে জানার কোনও উপায় নেই।
জোরপূর্বক নিয়োগ এবং নিখোঁজ হওয়া শুরুর পর থেকে তিনি এবং তার পরিবার কতটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছেন তা আরএফএ’র কাছে বর্ণনা করেছেন সাত বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো আলী।
তিনি বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে আমরা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।” মে মাসে তিনি তার ১৬ বছর বয়সী ছেলেকে ক্যাম্পের অন্য কোথাও আত্মীয়দের সাথে থাকতে পাঠিয়েছিলেন। জোরপূর্বক নিয়োগের জন্য একেকটি ছেলেকে অপহরণ করা হচ্ছে বলে প্রায় প্রতিদিনই তিনি শুনেছেন। তিনি তার সন্তানকে রক্ষা করতে পারবেন না এই ধারণায় মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন।
“গতকালের আগের দিন আমার ছেলে আমাকে বলেছিল এলাকাটিও নিরাপদ নয়। প্রতিদিন রাতে একদল লোক টহল দিচ্ছে। যখনই তারা কোনো ছেলেকে দেখতে পায়, তখনই তাদের টার্গেট করে মিয়ানমারে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য,” তিনি বলেন।
"মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আমাদের জন্য কোনো নিরাপদ স্থান নেই," বলেন তিনি।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। ফোরটিফাই রাইটস এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উভয়ই গত বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ব্যাপক দুর্নীতি, অপব্যবহার এবং চাঁদাবাজি প্রকাশ করা হয়।
এপিবিএন ২০২০ সাল থেকে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে। যোগাযোগ করা হলেও এপিবিএন-এর বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আরএফএ-র কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে গতবছর এপিবিএন বেনারনিউজকে বলেছিল, তারা ক্যাম্পের অধিবাসীদের রক্ষার জন্য অনেক কিছু করেছে।
এক অন্তহীন ফাঁদ
ফোরটিফাই রাইটসের কুইনলি বলেছেন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে মহিলাদের প্রতিবাদ এবং বৃহত্তর সম্প্রদায়ের চাপের কারণে আরএসও কে মে মাসে কৌশল পরিবর্তন করতে দেখা গেছে। আরএসও শিশুদের যুদ্ধে ব্যবহার এবং শিক্ষক ও রোহিঙ্গা নেতাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার দায় অস্বীকার করেছে। তারা দাবি করছে, জোর করে নিয়োগ করা হয়নি। ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংবাদ’ (Rohingya Refugee News) পরিচালনাকারী সাংবাদিক শফিউর রহমানের প্রকাশিত অডিও বার্তায়, আরএসও নেতা কো কো লিন এই ধরনের প্রতিবেদনকে প্রোপাগান্ডা বলে উল্লেখ করেছেন এবং নিজেদের হাজার হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক থাকার গর্ব করেছেন।
তিনি বলেন, “সাধারণ জনগণের ভয় পাওয়ার বা ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
কিন্তু এই ধরনের দাবি শিবিরের ভিতরে বসবাসকারীদের স্বস্তি দিতে তেমন কিছু করে না।
ভাইয়ের অপহরণের ঘটনার পর মুহাম্মদ আদৌ জানেন না আরএসও, আরসা নাকি অন্য কোনো দল ফরহাদকে নিয়ে গেছে। তিনি শুধু জানেন তার ভাই স্কুলে গিয়েছিল, বাড়িতে আসার চেষ্টা করেছিল এবং নিখোঁজ হয়েছে।
"আমি জানি না সে বেঁচে আছে কি না। কারণ শেষবার যখন আমি তার সাথে কথা বলতে পেরেছিলাম, আমার ভাই আমাকে বলেছিল যে তাদের খাবার নেই," মুহাম্মদ জুনে আরএফএকে বলেছিলেন। যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন তাদের ঘরের পাতলা ছাদ ভেদ করে বৃষ্টি ঝরছিল। তার ৪ বছর বয়সী আরেক শিশু এক কোণে ঘুমাচ্ছিল।
মুহাম্মদের মতে সীমান্ত পার হওয়ার প্রায় ছয় সপ্তাহ পর ফরহাদ অন্য তিন ছেলেকে নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। সে তার ভাইকে জঙ্গল থেকে ফোনে বলেছিল, তারা একজন পাচারকারীকে খুঁজে পেয়েছে, যে পর্যাপ্ত টাকা দিলে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে। তার কণ্ঠস্বর দুর্বল শোনাচ্ছিল এবং ফরহাদ স্বীকার করেছিল সে অসুস্থ। ফরহাদের মুক্তির জন্য কীভাবে তহবিল যোগাড় করতে হবে তা মুহাম্মদ ভেবেছিলেন। কিন্তু তার ভাইয়ের আর যোগাযোগ পাওয়া যায়নি।
এখন সময়ে সময়ে তিনি ভয় পান, অস্থির বোধ করেন বা রেগে যান। আজানা সেই নাম্বারে ফোন করলে অপর প্রান্ত থেকে ডায়াল টোন আসে, “নাম্বারটি এখন বন্ধ আছে”। কিন্তু এটাই শেষ নম্বর যেটা থেকে সে ফরহাদের কণ্ঠ শুনেছে। তাই বারবার চেষ্টা করা ছাড়া সে আর কি করতে পারে!