রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে সরব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2017.08.30
ঢাকা ও কক্সবাজার
উখিয়ার রহমতবিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা। উখিয়ার রহমতবিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা। আগস্ট ২৯, ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইনে নতুন করে সৃষ্ট রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে সরব হয়ে উঠেছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ। গত ছয়দিনে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওম)।

এদিকে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো বন্ধ করতে দেশটির প্রতি চাপ প্রয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের বলেন, “মানবিক বিবেচনায় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছি। এটি আমাদের জন্য একটি বিরাট সমস্যা। এজন্য মিয়ানমারের প্রতি প্রবল চাপ বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

বুধবার বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিস ওয়েলস’র তাঁর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে এই আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

গত ২৪ আগস্ট রাতে একসঙ্গে রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর রাজ্যটির বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সহিংসতায় এখনো পর্যন্ত ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ নিহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি।

সরব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃবৃন্দ

ইন্দোনেশিয়ার বার্তা সংস্থা মেরদেকা জানায়, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখার জন্য শিগগিরই মিয়ানমার যাবার পরিকল্পনা করছেন বলে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন।

মিয়ানমারের প্রতি বেসামরিক নাগরিক হত্যা বন্ধের আহ্বান জানানোর পাশপাশি নিরাশ্রয় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি।

এর একদিন আগে মারসুদি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উ থাং তুন এর সাথে টেলিফোনে আলাপ করেছেন বলে জানায় তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদলু।

মারসুদি মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে টেলিফোন আলাপের সময় রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের বিষয় তুলে ধরেছেন বলে বার্তা সংস্থাটি জানায়।

“নিরাপত্তা একটি মানবিক বিষয়; রাখাইন রাজ্যের জনগণেরও এটি পাওয়ার অধিকার রয়েছে,” সাংবাদিকদের বলেন মারসুদি।

এদিকে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রযুত চান-ও-চা গত মঙ্গলবার মিয়ানমারের সেনা প্রধান মিন মিন অং হ্লাইং এর সাথে এক বৈঠকে জানিয়েছেন যে সহিংতায় উদ্বাস্তু মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দিতে তাঁর দেশ প্রস্তুত।

তিনি জানান, থাইল্যান্ড রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী শিবির তৈরি করতে আগ্রহী, এবং যখন পরিস্থিতি শান্ত হবে তখন তারা নিজ দেশে ফিরে যাবে।

বুধবার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের নিকটবর্তী একটি প্রধান সড়কে মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধের দাবিতে হাজারের বেশি রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে ১০০জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির পুলিশ।

মালয়েশিয়ায় মিয়ানমার দূতাবাসের সামনেও আরেকটি ছোট বিক্ষোভ হয়েছে বলেও জানায় তারা।

এছাড়া বিক্ষোভকারীদের একজন নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরানোর চেষ্টার সময় পুলিশ তাকে থামায় বলে জানায় চ্যানেল নিউজ এশিয়া।

প্রসঙ্গত মালয়েশিয়ায় ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে, জাতিসংঘের হিসাবে যারা মূলত সে দেশে অতি নিম্ন মজুরির শ্রমিক হিসেবে কর্মরত।

উখিয়ার সীমান্তে রেজু আমতলী পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। ৩০ আগস্ট, ২০১৭।
উখিয়ার সীমান্তে রেজু আমতলী পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। ৩০ আগস্ট, ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

ছয়দিনে অনুপ্রবেশ ১৮ হাজার

বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইওএম’র কক্সবাজার প্রধান সংযুক্তা সাহানি জানান, “গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারে নতুন করে সংঘাত শুরু থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।”

এ ছাড়া অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তে নো ম্যানস ল্যান্ডে আরও শত শত রোহিঙ্গা আটকে রয়েছে বলে জানান তিনি।

সংযুক্তা বলেন, “তাদের বাঁচিয়ে রাখা বেশি জরুরি। এজন্য যা যা প্রয়োজন রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলমান কর্মসূচির আওতায় সকল এনজিও সংস্থার সমন্বয়ে তা করা হচ্ছে। তবে এ সহায়তা একেবারেই অপ্রতুল।।”

গত বছরের অক্টোবরের সহিংসতার পরে বাংলাদেশে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করে বলেও কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এক জরিপে জানায় আইওএম।

নিহত ছয়, আটক দেড় শতাধিক

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে কক্সবাজারের টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের কাছে দুটি নৌকা ডুবির ঘটনায় শিশুসহ ছয় রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বেনারকে জানান, বুধবার সকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি সাগরে নৌকা ডুবির ঘটনায় ভেসে আসা চার জনের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের দুই শিশু এবং দুজন নারী। তাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

শাহপরীর দ্বীপ ইউপি সদস্য নুর আমিন বেনারকে জানান, রাতে সাড়ে ১০টার দিকে দ্বীপের পশ্চিম পাড়া এলাকার কাছাকাছি মিয়নমার থেকে আসা আরও একটি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে এক শিশু ও এক নারীর মৃতদেহ স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করছে।

ডুবে যাওয়া নৌকায় থাকা আবদুর শুক্কুর নামে এক ব্যক্তি মৃত নারী তার স্ত্রী বলে দাবি করেন। তার নাম নুর জাহান।

এদিকে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারী ১৫২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

“বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বিভিন্ন সীমান্ত থেকে বিজিবির হাতে ৭৫ জন ও ৭৭ জন কোস্ট গার্ডের হাতে আটক হয়। এর মধ্যে ৮০ জন শিশু রয়েছে’” বেনারকে বলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।

তিনি বলেন, “খাবার, পানি, ওষুধ ও অন্যান্য মানবিক সহযোগিতা দিয়ে নিজ নিজ সীমান্ত দিয়ে যেকোনো সময় তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।”

এর আগে গত ছয় দিনে আরো প্রায় দেড় হাজারের মত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে মানবিক সহযোগিতা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয় বলে জানান আলী হোসেন।

এদিকে উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বেনারকে বলেন, সীমান্তে ‌দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের সহযোগিতার দায়ে ১৫ জন পুরাতন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে বিজিবি।

সহিংসতার দায়

সোমবার ইউটিউবে আপলোড করা এক ভিডিও বার্তায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এর প্রধান আতাউল্লা জুনুনি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের ওপর মর্টার শেল ও রকেট লাঞ্চার ছোড়ার অভিযোগ করেছেন মিয়ানমারের নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে।

এআরএসএ নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী এবং কোনো ধরনের বিদেশি সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বলে দাবি করলেও মিয়ানমার সরকার এই সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে।

এদিকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সাম্প্রতিক হামলার দায় স্বীকার করেছে এআরএসএ।

“তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি, গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রাস্তঘাটসহ সবখানেই শত শত মৃতদেহ,” দুইজন সশস্ত্র মুখোশধারী তরুণকে দুইপাশে রেখে করা ভিডিও বার্তায় বলেন আতাউল্লা।

“যদি যুদ্ধ করতেই হয়, তবে যে সকল তরুণ নিজেদের অধিকার ও আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো,” মিয়ানমার বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান আতাউল্লা।

গত শুক্রবার থেকে চলা সহিংসতায় রাখাইনের অন্তত ১০টি এলাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। উপগ্রহ চিত্রে এর প্রমাণ মিলেছে।

এই অগ্নিকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে রাখাইনে প্রবেশাধিকার দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এসব দাবি জানানো হয়।

উপগ্রহে পাওয়া নতুন তথ্য ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে বলে মনে করেন এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “রাখাইন রাজ্যে কোন মাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তা অনুধাবনের জন্য দাতা সংস্থা ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর উপদ্রুত এলাকায় প্রবেশের অনুমতি চাওয়া উচিত।”

সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে নির্যাতন বন্ধের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা ও সহিংসতার অভিযোগের তদন্ত এড়িয়ে যেতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।