গবেষণা প্রতিবেদন: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে বাংলাদেশও ‘বন্দিশিবির’

মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেও নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং তাঁরা মুক্ত জীবন থেকে বঞ্চিত। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশে এসেও যেন তারা বন্দিশিবিরে অবস্থান করছেন।

প্রায় ২৫০ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে শুক্রবার ৮৮ পাতার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ইয়ুথ কংগ্রেস রোহিঙ্গা (ওয়াইসিআর)।

প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা জানিয়েছেন যে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে চলাচল করতে গিয়ে তাঁদের মিয়ানমারের মতোই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি, কখনো কখনো মিয়ানমারের তুলনায় বেশি কঠোর।

রোহিঙ্গাদের চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ ছাড়াও নানা ধরনের নির্যাতনের জন্য ওয়াইসিআর বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) দিকে আঙুল তুলেছে।

কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে পুলিশের এই বিশেষ ইউনিট।

সরকারি বিধিনিষেধ কার্যকর করতে এপিবিএন নানা ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেয় অভিযোগ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “এপিবিএন রোহিঙ্গাদের ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালায়।”

ক্যাম্পের চারপাশে নির্মিত বেড়াগুলোর কারণে রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁদের পুলিশ চেকপয়েন্ট হয়েই চলাচল করতে হয়, যেখানে নানা স্বেচ্ছাচারী আচরণের শিকার হতে হয়।

ওয়াইসিআর বলছে, প্রতিবেদন তৈরির জন্য সংগঠনটি ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৩০টি শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২৪১ জনের ওপর জরিপ পরিচালনার পাশাপাশি ৫৮ জন শরণার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে।

এই গবেষণার জন্য ক্যাম্পে কর্মরত চার পুলিশ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

জরিপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ৭২ শতাংশ বলেছেন, শরণার্থীদের অবাধ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির পেছনে মূলত বাংলাদেশ সরকার দায়ী এবং সরকার এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করছে।

“একটি জবরদস্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যাতে করে রোহিঙ্গাদের ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর অথবা মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করা সহজ হয়,” বলা হয় প্রতিবেদনে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকার খুবই আন্তরিক। রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো বাহিনীর সদস্যরাও বিপদে পড়ছে।”

“কক্সবাজারে এখন স্থানীয়দের তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এই পরিস্থিতিতে যদি রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরা করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কেউ যদি বলে থাকে তারা মিয়ানমারের তুলনায় এখানে খারাপ আছে; এটা হবে চরম মিথ্যা,” বলেন তিনি।

মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়ন শুরু করার পর ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন।

মিয়ানমারের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) বিদ্রোহীদের দ্বারা মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চৌকিতে হামলার জবাবে এই ক্র্যাকডাউন করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাক্ষাৎকারে একজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর শুরুর দিনগুলো ভালোই ছিল।

সামিরা (প্রকৃত নাম নয়) নামে ৪৩ বছর বয়সী এক নারী শরণার্থী বলেন, “আমরা যখন প্রথম এখানে এসেছি, তখন আমাদের স্বাধীনতা ছিল। পরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশকে আনা হলো। ক্যাম্পের চারপাশে বেড়া স্থাপন করা হলো এবং ক্যাম্পের ভেতরের বাজার ও দোকানগুলো ভেঙে ফেলা হলো। এসব কারণে আমাদের জন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।”

rohingya 2.jpeg
কক্সবাজারের বালুখালি রোহিঙ্গা শিবিরে খেলছেন রোহিঙ্গারা। ২৭ আগস্ট ২০১৮। [এপি]

ঘুষ ও চাঁদাবাজির অভিযোগ

ক্যাম্পে সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ থাকে। দলে দলে জমায়েত হওয়া, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার নিষিদ্ধ ক্যাম্পে। এ প্রসঙ্গে জরিপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গারা বলেছেন, কারফিউ ভেঙে কেউ ধরা পড়লে পুলিশ তাঁদের মারধর, জরিমানা ও আটক পর্যন্ত করে। এছাড়া সঙ্গে থাকা পণ্য বা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কেড়ে নেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাম্পে চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য ধরনের দুর্নীতি পুলিশের জন্য সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

ওয়াইসিআরের প্রতিবেদন বলছে, “শিবিরে চেকপয়েন্ট পার হওয়া, কাজ করা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহন করা, স্বাস্থ্যসেবা চাওয়া, মোবাইল ফোন বহন, বিয়ে বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করা এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মতো—মৌলিক কাজ করতে গিয়েও পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়।

এতে আরও বলা হয়, গবেষণার জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে সরাসরি ঘুষ নেননি। তবে তিনি অন্যদের কথা জানেন; যারা ঘুষ নেন।

“কখনো কখনো আমার সহকর্মীরা তাদের (শরণার্থীদের) কাছ থেকে টাকা নেয়। তারা আমাকে কিছু দেয় অথবা আমরা সেই টাকা দিয়ে চা-নাস্তা খেয়ে নেই,” পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন ওই পুলিশ সদস্য।

ওয়াইসিআরের ভাষ্য, যদিও বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে তারা অপরাধ দমন, মৌলবাদ ও সহিংসতা কমাতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তবে বাস্তবতা হচ্ছে ক্যাম্পের সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং এপিবিএন উভয়ের সহিংসতার কারণেই সাধারণ শরণার্থীদের জীবন ক্রমশ অনিরাপদ হয়ে উঠছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমাদের বাহিনীর সদস্যদের ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে থাকা সশস্ত্র অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠা খুবই কঠিন কাজ।

“এত কিছুর পরও আমাদের বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে,” যোগ করেন তিনি।

rohingya 3.jpeg
কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের একটি বাজারে কেনাকাটা করছেন রোহিঙ্গারা। ১৫ মে ২০২৩। [এপি]

চলাফেরার স্বাধীনতার সুপারিশ

বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দাতা সংস্থাগুলোর জন্য ৩৯টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সরকারের জন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে: চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া; কারফিউ অপসারণ; রোহিঙ্গাদের ভাসানচর বা মিয়ানমারে স্থানান্তর করতে বাধ্য করার কৌশল বন্ধ করা; নিরাপত্তার জন্য পুলিশের বদলে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পুলিশি নির্যাতনের তদন্ত ও বিচার করা।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গাদের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া; বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের অপব্যবহারের জন্য জবাবদিহি করা এবং সুশীল সমাজ সংস্থাগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ মানবিক সহায়তা প্রদানে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর রোহিঙ্গা যুবকদের ক্ষমতায়নের উপায়, খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা এবং জীবনযাত্রার মান ও স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সুবিধার উন্নতির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত—সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

ফাতিমা (ছদ্মনাম) নামে ৩৫ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধৃতি করে বলা হয়, “তারা (কর্তৃপক্ষ) বলে, এই বিধিনিষেধগুলো রয়েছে কারণ আমাদের রেশন দেওয়া হয়। আমাদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার বা নিজের উপার্জনের প্রয়োজন নেই। আমি মনে করি, বিধিনিষেধের উদ্দেশ্য হলো আমাদের আত্মহত্যা করতে এবং এখানে মরতে বাধ্য করা।”

অবাধ চলাফেরা করতে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের মধ্যে থাকবে এটাই নিয়ম। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

দোকানপাট ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “ক্যাম্পের ভেতরে অনুমোদনহীন সব স্থাপনাই উচ্ছেদ করা হয়, বিশেষ করে দোকানগুলো। কারণ এগুলো ঘিরে ইয়াবাসহ নানা মাদকের কারবার গড়ে ওঠে।”