রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র: নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত দল

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.09.24
ঢাকা
190924_Rohingya_NID_1000.jpg মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে দেশ ছাড়ার দুই বছর পূর্তিতে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ। ২৫ আগস্ট ২০১৯।
[এএফপি]

অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার সাথে সম্পৃক্ত সরকারের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের চিহ্নিত করতে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন–দুদক, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ–সিটিটিসি ও নির্বাচন কমিশন–ইসি।

রোহিঙ্গাদের নাম জাতীয় সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তার অভিযোগে গত সোমবার কমিশনের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট শাহানুর মিয়াকে কাউন্টার টেররিজম বিভাগ আটক করেছে। এ ছাড়া মোট আটক ও চিহ্নিত হয়েছেন ১৫ জন।

নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব (জনসংযোগ) মো. আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে কমপক্ষে ১৫ জনকে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন। এরা সবাই চট্টগ্রাম ও ঢাকার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে কর্মরত কারিগরি বিভাগের কর্মী বা বিশেষজ্ঞ।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিক করার চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।”

তবে তিনি ধরা না পড়া সব কর্মকর্তার নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানান।

দুর্নীতি দমন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের বিষয়ে তদন্ত করতে নির্বাচন কমিশনের সাথে কাজ করে যাবে দুদক।

তিনি বলেন, “আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে যে, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার সাথে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জড়িত। তাঁরা কমিশনের ল্যাপটপ গায়েব করে এসব কাজ করছে।”

“এ জন্য একজন পরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করবে। ওই তদন্ত কমিটি এই দুর্নীতির সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করবে,” বলেন প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি। তাদের খাদ্য, নিরাপত্তাসহ সকল প্রকার মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু তারা দেশের আইন মানছে না। আইন ভঙ্গ করে, জালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নিচ্ছে।”

তিনি বলেন, “আমরা তদন্ত করে দেখছি রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট দেয়ার সাথে কারা জড়িত। জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।”

মন্ত্রী বলেন, “আমাদের কাছে আট লাখ প্রাপ্তবয়স্ক রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক ডেটা আছে। এখন থেকে পাসপোর্ট দেয়ার আগে আবেদনকারীদের বায়োমেট্রিক ডেটা মিলিয়ে দেখা হবে। এর ফলে কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিতে এলে ধরা পড়ে যাবে।”

টাকার বিনিময়ে ভোটার

রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সাথে সম্পৃক্ততার দায়ে কমিশনের চট্টগ্রাম অফিসের সহায়ক কর্মচারী জয়নাল আবেদীন, বিজয় দাস, সীমা দাস, সত্য সুন্দর দে এবং ঢাকা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে কর্মরত সাগরসহ পাঁচ কর্মচারীর বিরুদ্ধে ১৬ সেপ্টেম্বর মামলা করে নির্বাচন কমিশন।

ভোটার নিবন্ধন আইন-২০১০ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর আওতায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পুলিশ জয়নাল আবেদীন, বিজয় দাস, সীমা দাস, মোস্তফা ফারুক ও শাহানুর মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভোটার হিসাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা নেয়া হতো।

এজাহার অনুযায়ী, জয়নাল আবেদীন, বিজয় দাস, তাঁর বোন সীমা দাস, সত্য সুন্দর সাহা চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন অফিসের ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের নাম জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁরা ঢাকা নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তরের সার্ভারে রোহিঙ্গাদের নামগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সাগরের কাছে পাঠাতেন। সাগর নামগুলো সার্ভারে প্রবেশ করাতেন।

সাগর ছাড়াও শাহানুর মিয়া এই কাজে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। সাগর বর্তমানে পলাতক।

এই জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন রোহিঙ্গারা। গত ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে তিন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। তাঁরা অর্থের বিনিময়ে নোয়াখালী থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করেন।

এছাড়া গত ১৯ আগস্ট নির্বাচন কমিশন থেকে স্মার্ট কার্ড নিতে গিয়ে আটক হন লাকী নামের এক রোহিঙ্গা নারী। তাঁর স্বামী নজির আহমেদ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ যাওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন।

এই দু'জনকে আটকের পর রোহিঙ্গাদের এনআইডি সার্ভারে সংযুক্ত হওয়ার ঘটনায় অনুসন্ধানে নামে নির্বাচন কমিশন।

রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করার মামলাটি কাউন্টার টেররিজম বিভাগে হস্তান্তর করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্ত করে দেখবে এই প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসী উপাদান আছে কিনা। এ কারণে মামলাটি কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে হস্তান্তর করা হয়েছে।”

ভুয়া বাবা-মা সাজিয়ে পাসপোর্ট তৈরি

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আবু নায়েম মাসুম বেনারকে বলেন, গত দুই বছরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট করতে এসে ধরা পড়েছে। এদের বেশির ভাগই নারী এবং এক তৃতীয়াংশ তরুণী।

তিনি বলেন, “প্রথম দিকে ভুয়া ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে আসত। তবে এখন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দরিদ্র শ্রেণির কিছু ব্যক্তিকে টাকার বিনিময়ে বাবা-মা সাজিয়ে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এখানে আসার পর কথাবার্তায় গড়মিল পাওয়া গেলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, আর তখনই আসল তথ্য বেরিয়ে আসে।”

তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলার বাইরে থেকে অনেকে জন্ম সনদ নিয়ে আসছে পাসপোর্ট করার জন্য।

“এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে এক শ্রেণির দালাল জড়িত,” মন্তব্য করে আবু নায়েম বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে ইউনিয়ন থেকে রোহিঙ্গা নারীদের ভুয়া জন্ম সনদ, ভুয়া নাগরিকত্ব সনদ দেওয়া হচ্ছে এবং সেই সনদের লেখা এবং পাসপোর্ট ফরমের হাতের লেখা একজনের। তাতে মনে হয় ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রিক একটি দালাল চক্র এই অপকর্মের সাথে জড়িত রয়েছে।”

প্রতিবেদন তৈরিতে কক্সবাজার থেকে সহায়তা করেছেন সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।