রোহিঙ্গা শিবিরে ঘটছে অপহরণের ঘটনা

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2020.09.24
কক্সবাজার ও ঢাকা
রোহিঙ্গা শিবিরে ঘটছে অপহরণের ঘটনা1000 টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে অভিযান চালিয়ে এক অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধারকালে অস্ত্রসহ মো. সাদেক (২৬) নামের এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে এপিবিএন-১৬। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরে অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ  আদায়ের  ঘটনা ঘটেছে।  । রোহিঙ্গা  নেতাদের মতে, গত এক মাসে অর্ধশতাধিক  অপরহরণের  ঘটনা  ঘটেছে।

অপহরণকারীরা নিজেদের জঙ্গি সংগঠন আল-ইয়াকিনের সদস পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের তুলে যাচ্ছে।

শরণার্থীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সাধারন সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে অপরণের ঘটনা আগের তুলনায় বেড়েছে। গত এক মাসে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে অর্ধশতাধিক ঘটনার কথা আমরা জেনেছি।”

এসব ঘটনার ফলে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপহরণ আতঙ্ক বেড়ে গেছে বলে জানান ওই নেতা।

উখিয়া ও টেকনাফের  ৩৪টি  রোহিঙ্গা  ক্যাম্পের  নিরাপত্তার  দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা  বলেছেন,  অপহরণের কিছু ঘটনা ঘটলেও তা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো নয়। তা ছাড়া কেউ অপহৃত হলে তাকে উদ্ধার করা হচ্ছে।

আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি–আরসা (আগের নাম আল-ইয়াকিন) নাম ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের তুলে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, ক্যাম্পে আরসার অস্তিত্ব নেই। অনেক সময় সাধারণ অপরাধীরা এই সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে।

টেকনাফের  লেদার নতুন  রোহিঙ্গা   শিবিরের  নেতা মোস্তফা  কামাল  বেনারকে  বলেন, “বেশ  কয়েক  মাস  ধরেই  মুক্তিপণ  আদায়ের ঘটনা  বেড়েছেই চলেছে।  তিন  বছরে  শুধু  আমাদের  শিবিরেই  কমপক্ষে  ১৫টি  অপহরণের  ঘটনা  ঘটেছে।”

এপিবিএন-১৪ অধিনায়ক  মো.আতিকুর  রহমান  বেনারকে  বলেন, “উখিয়ার  ২১টি  শরণার্থীশিবিরে  গত  এক  মাসে  ১৫টি  অপহরণের  ঘটনা  ঘটেছে।  এর  মধ্যে  ১৩  জন  অপহৃতকে  আমরা  উদ্ধার  করতে  সক্ষম  হয়েছি।”

“তবে  মাত্র  তিনটি  ঘটনায়  মামলা  হয়েছে,”  বলেন  এই  পুলিশ  সুপার  (এসপি)।

এপিবিএন-১৬  এর  অধিনায়ক  মোহাম্মদ হেমায়েতুল  ইসলাম  বেনারকে  বলেন, “টেকনাফের  রোহিঙ্গা  ক্যাম্পগুলো  থেকে  পাঁচটি অপহরণের  অভিযোগ  পেয়েছি  আমরা। এ  ছাড়া  বিভিন্ন  সূত্রে  আরও  চার-পাঁচটি  ঘটনা  জানা গেছে।”

এসপি হেমায়েতুল  বলেন, “ঘটনাগুলো  বিশ্লেষণ  করলে  বোঝা  যায়,  বেশির  ভাগ অপহরণ  মুক্তিপণ আদায়ের কারণে  ঘটছে।”

উদ্ধার হওয়া অপহৃতরা যা বললেন

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের সূত্রে সম্প্রতি অপহরণের শিকার হওয়া ১২ জনের পরিচয় জানতে পেরেছে বেনার প্রতিনিধি।

তারা হচ্ছেন; উখিয়ার জামতলীর নুর আংকিজ (১২), একই শিবিরের মো. আবদুল্লাহ (৪০) ও মো. রশিদ (২৬), কুতুপালংয়ের শাহ আলম (১৭), আক্তার হোসেন (২৬), টেকনাফের লেদা শিবিরের আবুল ফয়েজ (৩৫), মো. আলমগীর (২৪), শালবন শিবিরের মো. একরাম (২৫) সৈয়দ আমিন (৩০), উনচিপ্রাংয়ের জাহেদ হোসেন (৩০), ইয়াছের আরফাত (১৮) এবং আলীখালী শিবিরের ইমান হোসেন (২২)।

গত আগস্টের  শেষ  সপ্তাহে  অপহরণের  শিকার  হয়েছিলেন  লেদার নতুন  শিবিরের  বাসিন্দা  মো.ইউনুছ  (৩৫)।

তিনি  বেনারকে  বলেন, “রাতে  ঘর  থেকে  আমাকে  ধরে  চোখ-মুখ  আর  হাত  বেঁধে  শিবির  সংলগ্ন  পাহাড়ে  নিয়ে  যায়  ‘আল-ইয়াকিনের’  লোকজন।  সেখানে  নিয়ে  লোহার  রড  ও  লাঠি  নিয়ে  ব্যাপক  মারধর  করে।”

ইউনুছ বলেন, “এভাবে  দুই  দফা  নির্যাতন  করে  রক্তাক্ত  করে  আমাকে।  এরপর  আমার  মোবাইল  দিয়েই  স্বজনদের  কাছে  ফোন  করে  ১০  লাখ  টাকা  মুক্তিপণ  চায়।  বিষয়টি  কাউকে  অবহিত  করলে  আমাকে  হত্যার  করা  হবে  বলে  ভয়  দেখানো হয়।”

তিনি জানান,  তাঁর  পরিবারের  সদস্যরা  সোনার  গয়না  বিক্রি  করে  ও  ঋণ  নিয়ে  পাঁচ  লাখ  টাকা  জোগাড়  করে  তা অপহরণকারীদের কাছে দিয়ে  ইউনুছকে  ছাড়িয়ে  আনে।  এখনো  তিনি  আহত  অবস্থায়  চিকিৎসা  নিচ্ছেন।

সর্বশেষ  গত  ৬  অক্টোবর  একই  শিবিরের  আমানউল্লাহ  (৩১)  ও  মোহাম্মদ  সেলিমকে  (১৬) ‘আল-ইয়াকিন’  পরিচয়  দিয়ে  তুলে  নিয়ে  যাওয়া  হয়  বলে অভিযোগ করেন রোহিঙ্গারা।

দুই  দিন  পর  তাদের  কাছ  থেকে  যথাক্রমে  ৩০  হাজার  ও  ৫৫  হাজার  টাকা  মুক্তিপণ  নিয়ে  ছেড়ে  দেয়  অপহরণকারীরা।

আমান বেনারকে বলেন, “দিন–দুপুরে  কয়েকজন  মুখোশধারী  অস্ত্রধারী  চোখ বেঁধে আমাকে  পাহাড়ে  নিয়ে  যায়।  সেখানে  তাদের  আস্তানায়  অস্ত্রশস্ত্রসহ  আরও  সদস্য  ছিল।  তারা  সবাই  খুব  ভয়ংকর প্রকৃতির।”

কক্সবাজার  জেলা  পুলিশের  অতিরিক্ত  সুপার  (প্রশাসন)  মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বেনারকে  বলেন, “আমরা  আগেও  বলেছি,  বাংলাদেশে  আরসার  কোনো  অস্তিত্ব  নেই।  তবে  ক্যাম্পের  অনেক  ছিঁচকে  অপরাধীও  আতঙ্ক  তৈরির  জন্য  তাদের  নাম  ব্যবহার  করে।”

“এদের  ব্যাপারে  পুলিশ  সব  সময়  সতর্ক  রয়েছে,”  বলেন  তিনি।

উখিয়ার  জামতলি,  কুতুপালং,  লম্বাশিয়া  এবং  টেকনাফের  লেদা,  নতুন  লেদা,  শালবন,  উনচিপ্রাং,  আলিখালী  ও  চাকমারকুলে  (পুটিবনিয়া)  এ  জাতীয়  ঘটনা  বেশি  ঘটছে  উল্লেখ  করে  রোহিঙ্গা  নেতা  ও  পুলিশ  কর্মকর্তারা  জানান,  শরণার্থীরা  এ  নিয়ে  ঝামেলা  বাড়াতে  চায়  না।

সাম্প্রতিক  এসব  অপহরণের  সাথে  জড়িত  আটজনকে  আটক  করা  হয়েছে  বলে  জানিয়েছে  এপিবিএন।  এর  মধ্যে  উখিয়া  থেকে  চারজন  এবং  টেকনাফ  থেকে  চারজনকে  গ্রেপ্তার  করা  হয়েছে।

সর্বশেষ  বুধবার  নয়াপাড়া  শিবিরে  অভিযান  চালিয়ে  অপহৃত  মো.  রশিদকে  (২৮)  উদ্ধার  এবং  অস্ত্রসহ  অপহরণকারী  মো.  সাদেক  (২৬)  নামে  এক  অপহরণকারীকে  গ্রেপ্তার  করা  হয়েছে।

শিবিরের  এপিবিএন-এর  পুলিশ  চৌকির  পরিদর্শক  রাকিবুল  ইসলাম  বেনারকে  বলেন, “রশিদের স্বজনদের  কাছে  মুক্তিপণ  চেয়ে  ৫০  হাজার  টাকা  দাবি  করেছিল  অপহরণকারীরা।”

এর  আগে  রোববার  শালবন  শিবির  থেকে  মো.  জাবের  (২৫)  নামের  এক  রোহিঙ্গা  যুবককে  তুলে  নিয়ে  গেছে  অপহরণকারীরা।

জাদিমুরা  রোহিঙ্গা  শিবিরের  নেতা  মো.  কালাম  বেনারকে  বলেন, “জাবেরকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে  পড়েছে।  তবে  তাঁর  লাশ  পাওয়া  যায়নি।”

তবে পুলিশ  পরিদর্শক  রাকিবুল  বলেন, “তাঁকে  উদ্ধারের  চেষ্টা  চালাচ্ছে  পুলিশ।  ”

“আমরা  চেষ্টা  করছি  যাতে ক্যাম্পে এ ধরনের ঘটনা আর না  ঘটে। শিবিরগুলোয় পুলিশের তৎপরতা  বৃদ্ধি  করা  হয়েছে,”  উল্লেখ  করেন  এপিবিএন-১৪  অধিনায়ক।

এপিবিএন-১৬  অধিনায়ক  বলেন, “যারা  এ  জাতীয়  কাজে  জড়িত  তাদের  চিহ্নিত  করে  আইনের  আওতায়  আনার  চেষ্টা  করা  হচ্ছে।”

এসপি আতিকুরের  দাবি, “বেশির  ভাগ  ক্ষেত্রে  ভুক্তভোগীরা  এ  জাতীয়  ঘটনা  গোপন  রেখে  অপহরণকারীদের  সঙ্গে  সমঝোতা  করে  ফেলে।”

তাঁর  বক্তব্যের  সত্যতা  নিশ্চিত  করে  উখিয়ার  লম্বাশিয়া  রোহিঙ্গা  শিবিরের  নেতা  মো.  রফিক  বলেন, “অনেক  সময়  এসব  বিষয়  আমাদের  কান  পর্যন্তও  আসে  না।”

ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের  অপরাধতত্ত্ব  বিভাগের  চেয়ারম্যান  অধ্যাপক  ড.  জিয়া  রহমান  বেনারকে  বলেন, “এমনটা  চলতে  থাকলে  শিবিরগুলোর  পরিস্থিতি  আরও  খারাপ  হতে  পারে।  সেখানে  আরও  ভয়াবহ  অপরাধের  সংস্কৃতি  গড়ে  উঠতে  পারে।”

তিনি বলেন, “এ  ব্যাপারে  আইনশৃঙ্খলাবাহিনী  শুধু  নয়,  স্থানীয়  জনপ্রতিনিধিদেরও  এখনই  সজাগ  হওয়া  উচিত।”

তাঁর মতে,  অপহরণকারীরা  কতটা  সংঘবদ্ধ  এবং  তারা  স্থানীয়  কারও  মদদ  পাচ্ছে  কিনা তা খতিয়ে  দেখতে  হবে।

টাঙ্গাইলের  মাওলানা  ভাসানী  বিজ্ঞান  ও  প্রযুক্তি  বিশ্ববিদ্যালয়ের  অপরাধ  ও  পুলিশ  বিজ্ঞান  (সিপিএস)  বিভাগের  চেয়ারম্যান  মো.আব্দুল  কাদের  মিয়া  বেনারকে  বলেন, “শরণার্থীরা  যাতে  ঘটনাগুলো  পুলিশকে  জানায়  তা  নিশ্চিত  করতে  সচেতনতামূলক  কার্যক্রম  চালানো  যেতে  পারে।”

“শরণার্থীশিবিরগুলোয়  কাজ  করাটা  পুলিশের  জন্যও  সহজ  নয়।  এ  ক্ষেত্রে  রোহিঙ্গা  নেতাদের উচিত পুলিশকে সহায়তা  করা,”  যোগ  করেন  তিনি।

খ্রিষ্টানধর্মাবলম্বী  রোহিঙ্গাদের  ফেসবুক  পেইজ  ‘আরসি  ব্রেকিং  নিউজ’-এ  ৩০  আগস্ট  প্রকাশিত  এক  ভিডিও-তে  দেখা  গেছে,  কয়েকজন  রোহিঙ্গা  নারী  প্ল্যাকার্ড  হাতে  নিয়ে  দাবি  করছে, “উখিয়ার  কুতুপাংশ  ক্যাম্পে  প্রায়  প্রতিদিন  ‘আল-ইয়াকিন’  এসে  নির্যাতন  চালায়  এবং  রোহিঙ্গাদের  অপহরণ  করে  নিয়ে  যায়।”

অপরাধ  ও  পুলিশ  বিজ্ঞানের  শিক্ষক  কাদের  মিয়া  বলেন, “এটা  খুবই  শঙ্কার।  আরসার  উপস্থিতি  নেই  সেটাইবা  আমরা  কী  করে  বলছি?” তাঁর মতে, “শুধু  আইনশৃঙ্খলাবাহিনী  নয়,  সবগুলো  গোয়েন্দা বাহিনী  এবং  সীমান্তরক্ষীদের  সঙ্গে  আলোচনা  করে  একটা  সমন্বিত  পরিকল্পনা  দরকার।  নয়তো  আরসার  নাম  ব্যবহার  করে  অপরাধ  বাড়তেই  থাকবে।”

আল-ইয়াকিনের  নামে হুমকি

চলতি  মাসের শুরুতে ভাসানচরে সরকারের  গড়ে  তোলা  আবাসন  ব্যবস্থা  দেখে  কক্সবাজারে  ফেরা  ৪০  জন  রোহিঙ্গা  নেতার  অনেকে  আল-ইয়াকিনের  সদস্য  পরিচয়ে  প্রাণনাশের  হুমকি  দেওয়া  হয়েছে।

নোয়াখালীর  হাতিয়া  উপজেলার  ওই  দ্বীপে  রোহিঙ্গা  স্থানান্তরের  ব্যাপারে  তাদের  নিষ্ক্রিয়  থাকার  নির্দেশ  দিয়েছে  হুমকিদাতারা।

টেকনাফের  শামলাপুর  শরণার্থীশিবিরের  হেড  মাঝি  (রোহিঙ্গা  নেতা)  নুর  মোহাম্মদ  বিষয়টি  মৌখিকভাবে  পুলিশকে  জানিয়েছেন।

গত  ১০ সেপ্টেম্বর  নুর  মোহাম্মদ  হুমকির  কথা  পুলিশকে  জানিয়েছেন  উল্লেখ  করে  স্থানীয়  বাহারছড়া  পুলিশ  তদন্ত  কেন্দ্রের  উপপরিদর্শক  (এসআই)  বাবুল  মিয়া  বেনারকে  বলেন, “অভিযোগ  খতিয়ে  দেখছে  পুলিশ।” তিনি জানান, অভিযোগকারীর  দাবি অনুযায়ী,  হুমকিদাতা  আবদুর  শুক্কুর  নিজেকে  কুতুপালং  রোহিঙ্গা  শিবিরের  বাসিন্দা  এবং  আল-ইয়াকিনের  সদস্য  হিসেবে  পরিচয়  দিয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।