বাংলাদেশে ‘হিন্দু হত্যাকারী’ রোহিঙ্গা আটকের খবর ‘সত্য নয়’

প্রাপ্তি রহমান
2017.09.27
ঢাকা
টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের পাশে স্কুল মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে ত্রাণ নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের পাশে স্কুল মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে ত্রাণ নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

মিয়ানমারের রাখাইনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘গণকবর’ উদ্ধার এবং এতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রেপ্তারের খবরটি সত্য নয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশের পুলিশ।

মঙ্গলবার বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াতে (আরএফএ) এ ধরনের একটি খবর প্রকাশের পর বেনারের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল।

কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বেনারকে বলেন, “রাখাইনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী‌দের গণকবর 'আ‌বিষ্কা‌রের' ঘটনায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আটকের খবর সত্য নয়।”

প্রসঙ্গত, গত রোববার ও মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাখাইনে দুটি গণকবর উদ্ধারের কথা জানিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। সোমবার উদ্ধার হওয়া গণকবরে ১৭ জন এবং রোববার ২৮ জন হিন্দুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা এই হিন্দুদের হত্যার পর গণকবর দিয়েছে বলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দাবি।

ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বাংলাদেশ ছয়জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে বলে মঙ্গলবার রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানিয়েছিলেন মিয়ানমারের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ইউ লিন অং।

হিন্দু শরণার্থী অপহরণকারীরা ‘আল ইয়াকিন’

এদিকে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন একজন হিন্দু রোহিঙ্গা শরণার্থীর অপহরণের পর মৃতদেহ পাওয়ার ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। ওই ঘটনায় কারা জড়িত সে বিষয়ে খোঁজখবর করছেন বলে জানিয়েছেন। এলাকায় পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে হরকাতুল আল ইয়াকিন সদস্যরা জড়িত। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও এ বছরের ২৪ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে হামলার দায় স্বীকার করেছিল এই সংগঠনটি। দলটির অপর নাম আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা বা ফেইথ মুভমেন্ট।

কুতুপালং বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন হিন্দু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে একটি শিবির খোলা হয়। ওই শিবির থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ১০জনকে কুতুপালং অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্যাতনের পর আটজনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও, দুজন নিখোঁজ ছিলেন। তাঁদের একজন রবীন্দ্র পালের লাশ মধুরছড়া থেকে উদ্ধার হয় গত রোববার। এখনো নিখোঁজ আছেন রবীন্দ্র পালের ভাই নিরঞ্জন শর্মা।

রবীন্দ্র পালের মেয়ে রেখা বালা বেনারকে বলেন, পরিচিত লোকজনই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

“দেশ ছাড়ার সময় আমরা গরু ছাগল কিছু সঙ্গে আনতে পারিনি। এখানে আসার পর আমাদের গ্রামেরই কিছু লোকজন বাবাকে ডেকে পাঠায়। বলে, গরু ছাগলগুলো তারা বিক্রি করেছে। বাবা যেন টাকা নিয়ে আসে। তারপর বাবা আর ফেরেনি,” রেখা বালা বেনারকে বলেন।

ওই একই দিন রবীন্দ্র পালের ভাই নিরঞ্জন শর্মা, রবীন পাল, বিধুরাম পাল, মধুরাম পাল, নিত্যানন্দ শীল, অনীল ধর, সুরধন পাল, মনিয়া শীল ও তাজল শীলকেও ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।

চারদিন আটক থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন মধুরাম পাল। তিনি তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত দেখান।

“ওরা আমাদের হাত উল্টো দিকে বেঁধে রেখেছিল। আর ধারালো জিনিস দিয়ে খুঁচিয়েছে। হাতে অস্ত্রও ছিল। বলেছে, হিন্দুরা ওদের দুশমন,” বেনারকে বলেন মধুরাম পাল।

তিনি বলেন, “ওরা আল ইয়াক্বীনের সদস্য। আমি দেখলেই চিনতে পারব।”

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন বেনারকে জানান, তাঁরা অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছেন।

“যারা অপহরণের পর ফিরে এসেছে, তাদের নিয়ে আমরা অভিযান চালাই। তারা পরিষ্কার কিছু বলতে পারছেন না। অভিযান অব্যাহত রয়েছে,” ইকবাল হোসেন বলেন।

যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ ছেড়েছেন

মিয়ানমারের মংডুর চিকনছড়ি থেকে এসেছেন নিতাই শীল। পেশায় নাপিত। তিনি বলছিলেন, গ্রামে থাকলে মরতে হবে এমন খবর পেয়ে ১১২টি পরিবার চলে আসে।

“সপ্তাহ খানেক সময় আমরা বাড়ি থেকে বের হতে পারছিলাম না। গ্রামের চারপাশ কালো কাপড় পরা লোকজন ঘিরে রেখেছিল। এরপর আমাদের প্রতিবেশীরা বলল পালিয়ে না গেলে ওরা গলা কেটে ফেলবে,” নিতাই শীল বলছিলেন।

এরপরই তাঁরা পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই কমপক্ষে ১২জন পুরুষ নিহত হন। তাঁদের আটজন নারী মুসলিম শরণার্থীদের সঙ্গে প্রথমে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ওঠেন। সেখান থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের নিয়ে আসেন।

হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ছিল না

রাখাইন রাজ্যে হিন্দু গণকবর উদ্ধার প্রসঙ্গে তাঁরা কেউ জানেন না বলে জানান বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু রোহিঙ্গারা। সঞ্জু বালা তাঁর স্বামী, দুই কন্যা ও নাতিকে হারিয়েছেন। তবে তিনি বলেন গ্রামে হিন্দু মুসলিমে তিনি কখনো কোনো বিরোধ দেখেননি।

“আরাকানে রাখাইনদের গ্রামগুলো আলাদা। হিন্দু, মুসলিম এক সঙ্গে একই গ্রামে থাকে। কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। এবারও যারা ঘিরে রেখেছিল তাদের আমরা চিনতে পারিনি,” সঞ্জু বলেন।

তিনি আরও বলেন, “মুখোশ পরা মানুষেরা মগ ভাষা ও রোহিঙ্গা ভাষা দুটোতেই কথা বলছিল।”

বাংলাদেশে আসছে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল

একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের এক মিয়ানমার প্রতিনিধিদল আগামী মাসে বাংলাদেশে আসছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া সহিংসতার পর এটিই হবে মিয়ানমার সরকারের কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম বাংলাদেশ সফর।

প্রসঙ্গত ওই সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে এখন পর্যন্ত চার লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

প্রতিনিধিদলটি তিন দিনের সফরে অক্টোবরের ১ তারিখ বাংলাদেশে আসতে পারে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়। এতে বলা হয়, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর এর দপ্তরের ইউনিয়ন মিনিস্টার কাও তিন সু’র নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরো দুইজন কর্মকর্তা থাকবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর আমন্ত্রণে প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ আসছে বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।

এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য যুক্তরাজ্যের দুই মন্ত্রী সংক্ষিপ্ত সফরে বৃহস্পতিবার ঢাকা আসছেন। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য অক্টোবরে ঢাকায় আসছেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদ্রিম ও মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদি।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে তুরস্ক ও জাপান। গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকে তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী রিসিপ আকদাগ ও জাপানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় উপমন্ত্রী ইয়াও রাই এ আশ্বাস দেন।

নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা বৃহস্পতিবার

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বৃহস্পতিবার আলোচনার কথা রয়েছে। এ উপলক্ষে বুধবার ঢাকায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশের কূটনীতিকদের রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠককে সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পদ্মায় এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

“কীভাবে কী বলতে হবে, কী করা উচিত, এ দেশ কী চায়- এসব নিয়েই কথা হয়েছে। বাংলাদেশ চায় যে রোহিঙ্গারা তার নিজের দেশে ফেরত যাক,” বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের চাপে ১৩ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিটি এসেছিল। এরপর সাতটি দেশের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডাকা হয়।

তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী ও কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।