নিরাপত্তার অভাবে কানাডায় গেলেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর আরো ১৪ আত্মীয়

সুনীল বড়ুয়া ও আহম্মদ ফয়েজ
2022.09.28
কক্সবাজাৱ ও ঢাকা
নিরাপত্তার অভাবে কানাডায় গেলেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর আরো ১৪ আত্মীয় কানাডা যাবার জন্য কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে ঢাকা যাবার জন্য বাসে উঠছেন নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর পরিবার সদস্যরা। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে নিজের সংগঠনের কার্যালয়ে আততায়ীদের হাতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ খুন হবার এক বছরের মধ্যেই নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডায় পাড়ি দিলেন তাঁর পরিবারের ২৫ জন সদস্য।

যাদের মধ্যে সর্বশেষ মুহিব উল্লাহর মা ও দুই ভাইসহ ১৪ জন কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ছেড়েছেন গত ২৬ সেপ্টেম্বর। এর আগে ৩১ মার্চ মুহিব উল্লাহর স্ত্রী নাসিমা খাতুন, ৯ সন্তান ও মেয়ের জামাইসহ ১১ সদস্য কানাডার চলে যান।

“গত রবিবার মুহিব উল্লাহর মা উম্মা ফজল, দুই ভাই হাবিব উল্লাহ ও আহমাদ উল্লাহ, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানসহ ১৪ জন রোহিঙ্গা শিবির থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন,” বুধবার বেনারকে বলেন ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’-এর তত্ত্বাবধানে ওই ১৪ জনকে এপিবিএন কক্সবাজার থেকে ঢাকায় পৌঁছে দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সোমবার রাতে তাঁরা কানাডার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।”

বন্দুকধারীদের গুলিতে মুহিব উল্লাহ নিহত হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তার অভাবে তাঁর ভাই রশিদ উল্লাহ তৃতীয় কোনো দেশে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাঁদের দাবির প্রেক্ষিতে দুই দফায় পরিবারের ২৫ সদস্যকে কানাডায় স্থানান্তর করা হয়।

মুহিব উল্লাহ’র পর খুন হন আরো ২৭ রোহিঙ্গা

রোহিঙ্গাদের অধিকার ও অবস্থান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরে এবং প্রত্যাবাসনের পক্ষে লাখো জনতার সমাবেশ করে আলোচনায় আসা মুহিব উল্লাহকে হত্যার পর কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে হত্যা যেন থামছেই না।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ায় আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহকে হত্যার পর ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসার ছয় ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা।

এপিবিএন-এর তথ্যমতে, মুহিব উল্লাহ হত্যার পর কক্সবাজারে ক্যাম্পে ২৭ রোহিঙ্গাকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করেছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ।

এসব ঘটনায় প্রায় ৩০০ জনকে আটক করা হয়, যাদের অর্ধেকেরও বেশি রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কথিত সদস্য বলে দাবি পুলিশের।

মুহিব উল্লাহ পরিবার এবং অন্যান্য রোহিঙ্গা নেতাদেরও দাবি, এইসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে আরসা জড়িত। এদের অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও আতঙ্কে আছেন শিবিরের অনেকেই।

“মুহিব উল্লাহ হত্যার সাথে জড়িত অনেক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিচারও শুরু হয়েছে। কিন্তু ক্যাম্পে রক্তারক্তি থেমে নেই,” বেনারকে বলেন এআরএসপিএইচ-এর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মেদ জুবায়ের।

আরসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ শরণার্থী শিবিরে প্রতিনিয়ত হত্যা, অপহরণসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা এক দুর্বিষহ যন্ত্রণার কারণে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, এখানেও তাঁদেরকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করে যেতে হচ্ছে। মৃত্যুর ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন।”

তিনি বলেন, “মুহিব উল্লাহ হত্যার ঘটনায় সরকার যে তৎপরতা দেখিয়েছে তাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা খুবই সন্তুষ্ট। কিন্তু সবারই চাওয়া রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদে থাকতে পারে।”

হত্যা মামলার অগ্রগতি

মুহিব উল্লাহকে হত্যার পরদিন ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি বর্তমানে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইলের আদালতে বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে বলে বেনারকে জানান আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম।

এই মামলায় ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে এবং ৩১জনকে সাক্ষী রেখে গত ১৩ জুন পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় বলে জানান তিনি।

“১১ সেপ্টেম্বর মামলাটির অভিযোগ গঠন সম্পন্ন করেছেন আদালত। বর্তমানে মামলাটি বিচার শুরু হবার অপেক্ষায় রয়েছে,” বলেন ফরিদুল।

মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে ৩৬ জনকে জড়িত হিসেবে শনাক্ত করা হলেও সাত জনের ঠিকানা ও অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।

তিনি জানান, অভিযুক্তদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমানে জেলে ও ১৪ জন পলাতক।

কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে “চারজন হত্যাকাণ্ডের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে” আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

“মুহিব উল্লাহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পক্ষে সক্রিয় থাকার কারণে এবং রোহিঙ্গাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় প্রত্যাবাসন বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘আরসা সদস্যরা’ তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে,” মনে করেন পিপি ফরিদুল।

“যে ২৯ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে তারা সবাই আরসার সদস্য এবং আরসা প্রধান জুনুনীর নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়,” যোগ করেন তিনি।

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। বর্তমানে নতুন ও পুরনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ টি রোহিঙ্গা শিবির ও নোয়াখালীর সাগরদ্বীপ ভাসানচরে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।

পাঁচ বছর পার হলেও একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।

প্রতিবেদনে কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

Quddus Shekh
2022-09-29 01:35

After the murder of Muhib Ullah, who raised the rights and position of the Rohingyas to the international community and gathered millions of people in favor of repatriation, the killings in the refugee camp of Cox's Bazar did not stop. In these incidents, about 300 people were detained, more than half of whom belonged to the Rohingya militant organization Arakan Rohingya Salvation Army ( Arsa) is claimed by the police to be an alleged member.