কুতুপালংয়ে শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যা

সুনীল বড়ুয়া ও আবদুর রহমান
2021.09.29
কক্সবাজার
কুতুপালংয়ে শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যা ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক চলাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৭ জন সংখ্যালঘু প্রতিনিধি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মুহিবুল্লাহ (ডান থেকে দ্বিতীয়)। ১৭ জুলাই ২০১৯।
[এএফপি]

কক্সবাজার উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মো. মুহিবুল্লাহকে (৫০) একদল অস্ত্রধারী গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন। 

বুধবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের মধ্যে লম্বাশিয়ায় অবস্থিত এআরএসপিএইচ কার্যালয় থেকে পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে বলে জানিয়েছেন ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হক। 

“প্রাথমিকভাবে ধারণা পাওয়া গেছে যে, হত্যাকারীরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ছিল। প্রত্যাবাসনের পক্ষে মুহিবুল্লাহ জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। আবার প্রত্যাবাসন বিরোধী একটি গ্রুপও রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় আছে, যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে,” জানান নাঈমুল হক। 

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “উখিয়ায় (ক্যাম্প-১ ইস্ট, ডি ব্লক‍) তাঁর অফিসে ৫-৬ জন অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারী ঢুকে পড়ে। তারা মুহিবুল্লাহর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। এক পর্যায়ে বন্দুকধারীরা তাঁকে এলোপাথাড়ি গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়।” 

এরপর আশপাশের লোকজন পুলিশকে খবর দিলে ঘটনাস্থল থেকে মুহিবুল্লাহকে উদ্ধার করে ক্যাম্পের এমএসএফ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান তিনি। 

“মুহিব উল্লাহর মরদেহ কক্সবাজার হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে,” যোগ করেন নাঈমুল। 

নিহত এই রোহিঙ্গা নেতা ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে রাখাইনের মংডু টাউনশিপের সিকদার পাড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আশ্রয় নেন কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে। 

নয় সন্তানের জনক ছিলেন মুহিবুল্লাহ। মিয়ানমারে থাকতে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন বলে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের কাছে তিনি ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামে পরিচিত ছিলেন। 

rohingya_muhib2.jpg
উখিয়ার কুতুপালংয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের কার্যালয়ে মুহিব উল্লাহ। ১৯ জুলাই ২০১৭। [এএফপি]

‘রোহিঙ্গাদের জন্য বড়ো ক্ষতি’

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উল্লাহ জানান, “রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করায় আমাদের নেতাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, যাতে আর কেউ রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে কাজ না করে। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তার এই মৃত্যু রোহিঙ্গাদের জন্য বড়ো ক্ষতি।” 

মৃত্যুর প্রায় দশ মিনিট আগে মুহিবুল্লাহ উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী নেত্রী জামালিদা বেগমকে ফোন করে আগামী শুক্রবার একটি বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন। 

ঘটনার পর জামালিদা বেনারকে জানান, “বৈঠকে মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী নতুন দলের বিষয় নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল।” 

“নিহত মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের মধ্যে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলার জন্য তিনি জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও সাক্ষাত করেছিলেন। রোহিঙ্গাদের অধিকার দিয়ে তিনি সব সময় বিদেশি বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করতেন,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ রফিক। 

২০১৯ সালে ১৭ জুলাই ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক চলাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৭ জন সংখ্যালঘু প্রতিনিধি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মুহিবুল্লাহ। 

২০১৯ সালে মাসের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে মহাসমাবেশ করে রোহিঙ্গারা। ওই সমাবেশে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা জড়ো হন। মুহিবুল্লাহ ওই সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তখন থেকে তিনি আলোচনায় উঠে আসেন। বেশ কয়েকমাস তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারিতে ছিলেন। 

মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তা, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটা ফেরতসহ সাত দফা পূরণ না হলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। এখনো ওই দাবিতে অনড় রয়েছে রোহিঙ্গারা। 

মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে “এখনই কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়” বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামশু দ্দৌজা নয়ন। 

‘প্রয়োজনীয় সুরক্ষা’ পাননি মুহিবুল্লাহ’

মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডকে “খুবই হৃদয়বিদারক,” হিসেব আখ্যায়িত করে তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “মুহিবউল্লাহ রোহিঙ্গাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা ছিলেন। তিনি যথাযথ সম্মান ও অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফেরার জন্য তৎপর ছিলেন।” 

মীনাক্ষী আরো বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি যথাযথ নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়েও সোচ্চার ছিলেন মুহিবুল্লাহ। 

এদিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ মুহিবুল্লাহকে যথাযথ সুরক্ষা দেয়নি বলে এক তাৎক্ষণিক বিবৃতিতে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস।

“বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের জঙ্গিরা এর আগে মুহিবুল্লাহকে জীবননাশের হুমকি দিয়েছিল, যার কারণে তখন তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়। তিনি কখনো তার প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পাননি,” বুধবার এক বিবৃতিতে জানান ফর্টিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ। 

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে “সহিংসতা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা” উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বুধবার এক বিবৃতিতে মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। 

পাশাপাশি শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। 

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডকে ‘দুঃখজনক’ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও সেখানে শান্তি বজায় রাখার জন্য তারা নিবিড়ভাবে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছে। 

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে নতুন ও পুরনো মিলে কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে বসবাস করছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।