কক্সবাজার যাবার জন্য ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের অনশন, ধর্মঘট ভাঙতে মারধরের অভিযোগ

শরীফ খিয়াম
2020.10.01
ঢাকা
201001-BD-Rohingya-BhashanChar-boat1000.jpg নৌকা থেকে ভাসানচরে নামছেন রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণ শ্রমিকরা। ১৫ অক্টোবর ২০১৮।
[এএফপি]

ভাসানচরে ‘আটকে’ রাখার প্রতিবাদ করা রোহিঙ্গাদের মারধর করার অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এই অভিযোগ করা হয়।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ওই দ্বীপে মে মাস থেকে থাকা ৩০৬ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে স্বজনদের কাছে ফেরার দাবিতে অনশন শুরু করায় নৌবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের পিটিয়েছেন বলে জানায় সংস্থাটি।

তবে এইচআরডব্লিউ’র অভিযোগকে “অবাস্তব, অসত্য, বিভ্রমজনক এবং মিথ্যাচারের শামিল,” উল্লেখ করে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বৃহস্পতিবার জানায়, নৌবাহিনীর সদস্যরা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের “স্বাচ্ছন্দ্যকর জীবনযাত্রা” নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি অন্যান্য বাহিনীর সাথে যৌথভাবে তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন।”

এক প্রশ্নের জবাবে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমোডর এ এ মামুন চৌধুরী আইএসপিআর-এর বক্তব্য সমর্থন করে বেনারকে বলেন, “গত ২১-২২ তারিখের দিকে তারা (রোহিঙ্গারা) অনশন করেছিল। তবে তাদের কেউ কোনো ধরনের ক্ষতির শিকার হননি।”

এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের মারধরের যে অভিযোগ এসেছে তা সঠিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা তাদের বুঝিয়ে ও ‘মোটিভেট’ (অনুপ্রাণিত) করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছি।”

এইচআরডব্লিউ দাবি করেছে, ২১ সেপ্টেম্বর থেকে অনশন শুরু করা আট শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে তারা। এমনই একজন তাদের বলেছেন, “নৌবাহিনীর সদস্যরা আমাদের পেটাতে গাছের ডাল ও কালো রাবারের লাঠি ব্যবহার করেছিল। তারা প্রতিবাদকারী নারী-পুরুষ, এমনকি তাদের সাথে থাকা শিশুদেরও মারধর করেছে।”

মাহবুবুর রহমান (১৯) নামে এক রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে মুঠোফোনে বেনারকে বলেন, “পরিবারের সদস্যদের কাছে ফেরার দাবিতে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিন দিন আমরা খাবার না খেয়ে উপাস ছিলাম। পরে আমরা নারী-পুরুষ সবাই যখন ভবন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, তখনই আমাদের মারধর করা হয়।”

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁর স্বজনরা আছেন বলেও জানান মাহবুব।

মো. জোবাইর (২০) নামে আরেক রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে বেনারকে বলেন, “তিন দিন না খেয়ে থাকার পরও আমাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়নি। প্রায় পাঁচ মাস ধরে এখানে আমরা কষ্টের দিন কাটাচ্ছি।”

এইচআরডব্লিউ বেশ কিছু ছবি যাচাই করে মারধরের কারণে শরণার্থীদের আহত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। এছাড়া প্রাপ্ত ভিডিও বিশ্লেষণের কথা উল্লেখ করে বিবৃতিতে জানিয়েছে, অনশন ধর্মঘটের সময় এক রোহিঙ্গা নারী বলছিলেন, “আমরা খাবার চাই না, আমরা শুধু চাই আমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে।”

তবে “ভাসানচরের রোহিঙ্গারা ভালো আছেন,” দাবি করে নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) দীপক জ্যোতি খীসা বেনারকে বলেন, “তাঁদের কাউকে মারধর করা হয়নি এবং সেখানে কোনো অনশনের ঘটনাও আমাদের জানা নেই।”

আশা ছাড়েননি শরণার্থীরা

এইচআরডব্লিউ বলেছে, অনশন ভাঙলেও রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে ফিরে যাওয়ার আশা ছাড়েননি।

এদিকে গত ২২ সেপ্টেম্বর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার নিয়ে যাবার বিষয়টি আলাপ হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বেনারকে জানান ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক।

এর আগে সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বেনারকে জানান, ‘শিগগিরই’ জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ রোহিঙ্গাদের আরো একটি প্রতিনিধি দলকে ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখাতে নিয়ে যাবে সরকার।

ওই সফরের পরই ভাসানচরে থাকা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান তিনি।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্যাতনের প্রতিবেদনগুলো দেখে মনে হচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাসানচরে জাতিসংঘের সুরক্ষা সফরটি হওয়া উচিত। যাতে আমরা সেখানকার শরণার্থীদের সাথে সরাসরি কথা বলতে পারি।”

সরকারের তীব্র সমালোচনা

ভাসানচরকে নিরাপদ প্রমাণের জন্য রোহিঙ্গাদের সেখানে আটকে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে সংস্থটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, “পরিবারের সাথে পুনরায় মিলিত হতে চাওয়া মানুষদের মারধর করা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।”

বিবৃতিতে বলা হয়, দ্বীপটি নিরাপদ এবং বসবাসের উপযুক্ত দেখানোর আসল উপায় হচ্ছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের দ্বীপটির একটি স্বাধীন মূল্যায়ন করার অনুমতি দেওয়া এবং সেখানে সবার স্বেচ্ছায় স্থানান্তর নিশ্চিত করা।

কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির থেকে কমপক্ষে এক লাখ শরণার্থীকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ওই দ্বীপে স্থানান্তরের জন্য রাজি করাতে গত মাসের শুরুতেই দুই নারীসহ ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে দ্বীপটি দেখিয়ে আনে সরকার।

এইচআরডব্লিউর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ওই ৪০ জনের মধ্যে রোহিঙ্গা নেতাদের পাশাপাশি দ্বীপে আটকে থাকা কয়েকজনের পরিবারের সদস্যও ছিলেন।

সেই স্বজনদের সাথেই কক্সবাজারে ফেরার দাবি জানিয়েছিল তারা।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক কর্মকর্তা আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “সঙ্গনিরোধের কথা বলে ভাসানচরে নিয়ে এভাবে আটকে রাখার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের বিশ্বাসহীনতা বাড়াবে। সেখানে জোর করে নিয়ে যাওয়ার ভীতিও তৈরি করতে পারে।”

উল্লেখ্য, অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা ওই ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৮৬ জন মহিলা, ৯৬ জন পুরুষ এবং ২৪টি শিশু।

যেতে রাজি দুই রোহিঙ্গা পরিবার

ভাসানচর থেকে ফেরার ১৭ দিন পর গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুর থেকে সেখানকার আবাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোয় প্রচারনা শুরু করেন রোহিঙ্গা নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় সেখানে যেতে রাজি হয়েছে দুটি রোহিঙ্গা পরিবার।

টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম ও উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মো. হামিদ বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, তাঁদের দুইজনের শিবির থেকে দুই পরিবারের দশ জন সদস্য স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছেন।

কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।