শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত ৬৯ শতাংশ রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর

শরীফ খিয়াম
2018.10.03
ঢাকা
181003_Education_Rohingya_1000.jpg কক্সবাজার উখিয়ার মেগা-ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শিশু আছিয়া ও আব্বাস। ২১ আগস্ট ২০১৮।
শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ

মিয়ামনার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৬৯ শতাংশ শিশু-কিশোর ও তরুণ এখনও শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত। পরিস্থিতি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে গত ২৭ সেপ্টেম্বর এ তথ্য প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)।

আইএসসিজি’র সমন্বয় কর্মকর্তা ও মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “বিশ্বের আর কোথাও মাত্র এক বছরের ৩১ শতাংশ শরণার্থী শিশু শিক্ষার আওতায় আসেনি। আমাদের এখানে এখনও রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে।”

রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য পাঠ্যক্রম প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে বলেও জানিয়েছে আইএসসিজি। পাঁচ থেকে সাত বছর এবং আট থেকে ১২ বছর বয়সীদের পাঠ্যক্রম তৈরি হয়ে গেছে, যা এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ১৩ থেকে ১৫ এবং ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের পাঠ্যক্রম আগামী ১৫ অক্টোবর চূড়ান্ত হবে।

“পাঠ্যক্রম চূড়ান্ত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের শিক্ষাগ্রহণের হার আরও বাড়বে,” এমনটাই প্রত্যাশা সৈকতের। এ কাজে বাংলাদেশ সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে বলেও তিনি জানান।

এর আগে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সর্বশেষ প্রয়োজন এবং জনসংখ্যা নিরীক্ষণ (এনপিএম) প্রতিবেদনেও রোহিঙ্গাদের উপযুক্ত পাঠ্যক্রমের অভাব থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্তমানে বিভিন্ন শিবিরে পরিচালিত কেন্দ্রগুলোর অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামো নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারাও সন্তুষ্ট নন।

মেগা-ক্যাম্পে বসবাসকারী মংডুর দুমচাপাড়ার আদি বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন (৩৭) বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পের কেন্দ্রগুলোয় বাচ্চাদের শিক্ষার কোনও প্রকৃত ব্যবস্থা নেই। শুধু খেলাধুলা-আনন্দ করার সুযোগ রয়েছে।”

মংডুর চালিপাড়া থেকে আসা ২৮ বছর বয়সী সৈয়দ ইসলাম বেনারকে বলেন, “সব বয়সীদের একই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আট বছরের ছোট বাচ্চারা কিছু জানতে পারলেও বড়দের জন্য নতুন কিছু শেখার নেই।”

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের একটি শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮ আগস্ট ২০১৮।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের একটি শিক্ষাকেন্দ্র। ১৮ আগস্ট ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ
কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের শিক্ষা-সংক্রান্ত প্রয়োজনের ওপর গত জুনে তৈরি এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের অভিভাবকেরা মনে করেন, শিক্ষাকেন্দ্রের বিদ্যমান পাঠ্যক্রম তাঁদের সন্তানদের বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যা শেখানো হচ্ছে তা অপ্রাসঙ্গিক।

১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৪৭ শতাংশ বালক এবং ৪০ শতাংশ বালিকার পিতা-মাতার অভিমত, এ ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে মেগা-ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ফয়েজু আরাকানির (৪৮)।

বেনারকে তিনি বলেন, “যেসব বাচ্চা গত বছর মিয়ানমার সরকারের তাড়া খেয়ে এখানে এসেছে, তারা সকলেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আছে। যে কারণে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোয় আপাতত খেলাধুলা, ছবি আঁকার মতো বিভিন্ন আনন্দদায়ক কাজে ব্যস্ত রেখে শিশুদের মনের অশান্তি দূর করা চেষ্টা করা হচ্ছে।”

“অত্যাচারের ‘ট্রমা’ থেকে বের হওয়ার পরই তারা প্রকৃত শিক্ষাগ্রহণের উপযোগী হবে,” বলেন তিনি।

আইএসসিজি মুখপাত্র জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণেও কাঙ্ক্ষিত মান অনুযায়ী শিক্ষা কাঠামো তৈরী হচ্ছে না।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে প্রণীত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি)-২০১৮’ অনুযায়ী ৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী পাঁচ লাখ ৩০ হাজার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে শিক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে আগাচ্ছে দাতা সংস্থাগুলো।

আইএসসিজি বলছে, ২৩ সেপ্টেম্বর অবধি এক লাখ ৬৩ হাজার ১৩ জন শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৪১ হাজার ৩৮৮ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয়েছে।

তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামে নির্মিতব্য সাড়ে তিন হাজার শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে এখন অবধি মোট দুই হাজার ১৮টি নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ কেন্দ্র এখনও তৈরি হয়নি। তবে ৪৬৫টি শিক্ষাকেন্দ্রে পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এর আগে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলেছে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে তারা চার থেকে ১৪ বছর বয়সী এক লাখ ছয় হাজার ৪৯৩ শিশুকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান অব্যাহত রেখেছে।

অন্যদিকে আইএসসিজি বলছে, শিবিরগুলোয় প্রি-প্রাইমারি ও প্রাইমারি পড়ার উপযোগী তিন থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় দেড় লাখ শিশু এখনও শিক্ষার আলোয় আসেনি। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী এক লাখ ১৭ হাজার কিশোর-তরুণের মধ্যে মাত্র তিন হাজার শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে।

এরই মধ্যে চলতি বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে ১১০টি এবং প্লাবনে আরও ৭০টি শিক্ষাকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজারে ‘পরিস্থিতির শিকার’ কমপক্ষে ১৩ লাখ মানুষের মধ্যে সাত লাখ তিন হাজারই শিশু। শুধু শরণার্থী নয়, স্থানীয় শিশুদেরও এই হিসাবের আওতায় রাখা হয়েছে। দাতা সংস্থা এডুকেশন ক্যাননট ওয়েট (ইসিডব্লিউ) ২০ সেপ্টেম্বর জানায়, কিশোর বয়সীসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা সাত লাখ ৬৫ জন।

এর মধ্যে গত বছরের ২৫ আগস্টের পরে আসা তিন লাখ ৯১ হাজার পাঁচশ শিশুর মানবিক সহায়তার প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ। আইএসসিজি জানিয়েছে, চরম ঝুঁকিতে রয়েছে ১১ হাজার ৭৬ জন শিশু-কিশোর। এর মধ্যে ছয় হাজার ৫৪ জন একাকী ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, “ঝুঁকিতে থাকা এই শিশু-কিশোরদের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে কমিশনের।” চাইল্ড প্রোটেকশন সাব সেক্টর (সিপিএসএস) সাড়ে চারশটি শিশু বান্ধব স্থান (সিএফএস) পরিচালনা করছে।

মিলছে না প্রয়োজনীয় অর্থ

কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের সার্বিক চাহিদা মেটাতে ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি)-২০১৮’ অনুযায়ী চলতি বছর ৯৫১ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হলেও সেপ্টেম্বর অবধি মাত্র ৩৬২ মিলিয়ন, অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার জন্য ১৩ দশমিক তিন মিলিয়ন ডলার অনুদান মিলেছে, যা এ খাতের মোট চাহিদার মাত্র ২৮ শতাংশ।

পরিকল্পনা অনুযায়ী আগাতে চলতি বছরে শুধুমাত্র শিক্ষা খাতের জন্য কমপক্ষে আরও ৪৭ মিলিয়ন ডলার দরকার। তবে এই পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে কি’না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে আইএসসিজি’র। সৈকত জানান, আগামী তিন মাসে আরও কিছু অনুদান আসলেও লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশও অর্জিত হবে না।

“আগামী বছরও প্রয়োজনীয় অনুদানের এমন অভাব থাকলে শুধু শিক্ষা নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাধ্য হয়েই শরণার্থীদের জীবন উন্নয়নের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা সংকোচন করতে হবে,” বলেন তিনি।

অনুদান সংকটের বিষয়টি জানিয়েছে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থাও (ইউএনএইচআরসি)। তাদের মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা বেনারকে বলেন, “গত বছরের তুলনায় অনুদান পাওয়ার হার বেশ কমেছে।”

চলতি বছর তাঁরা মোট ২৩৮ দশমিক আট মিলিয়ন ডলারের জন্য আবেদন জানালেও তার মাত্র ৪৪ শতাংশ পাওয়া গেছে বলে ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিসেফ চলতি বছরের কাঙ্ক্ষিত অনুদানের ৭২ শতাংশ ইতোমধ্যে পেয়ে গেলেও তাদের আরও ৪২ দশমিক চার মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।