রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা: প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসব সংক্ষিপ্ত করল বৌদ্ধরা

জেসমিন পাপড়ি
2017.10.06
ঢাকা
প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ঢাকার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে প্রার্থনারত বৌদ্ধরা। প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ঢাকার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে প্রার্থনারত বৌদ্ধরা। অক্টোবর ৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে ও তাদের দুর্দশার প্রতি সমবেদনা জানাতে এবারের প্রবারণা পূর্ণিমায় জাঁকজমকপূর্ণ ফানুস উৎসব পালন করেনি বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজ। এমনকি ভাসানো হয়নি কল্প জাহাজও।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি অসীম রঞ্জন বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “ফানুস উড়ানো আমাদের বৌদ্ধ ধর্মীয় আচারের একটি অংশ। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপরে যে ধরনের অত্যাচার চালাচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানাতে এবার আমরা জাঁকজমকপূর্ণ এ আয়োজন বর্জন করেছি।”

এবারে প্রবারণা পূর্ণিমায় রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ প্রার্থনার পাশাপাশি ফানুস উৎসব আয়োজনের অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য গঠিত ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন।

“রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেই এবারের প্রবারণা পূর্ণিমার আয়োজন সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। তা ছাড়া ফানুস ওড়াতে যে অর্থটা ব্যয় হয়, সেই অর্থটা আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য গঠিত ত্রাণ তহবিলে দান করব,” বলেন অসীম রঞ্জন বড়ুয়া।

প্রবারণা উৎসব শেষ হলেও এখনো এসব অর্থ তাঁদের হাতে এসে পৌঁছায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব টাকা আসবে। সেগুলো পেলেই হস্তান্তর করা হবে।”

রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের দমন নীতির সমালোচনা করে বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন জানিয়েছে, মিয়ানমারের এক শ্রেণির বৌদ্ধ রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে, তা গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতির পরিপন্থি। এর জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় লজ্জিত।

বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি বলেন, “বৌদ্ধ প্রধান দেশ হিসেবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধরা মিলে রাখাইনে মুসলমানদের ওপর যা করছে, তার জন্য একজন বৌদ্ধ হিসেবে আমরা অত্যন্ত লজ্জিত। বৌদ্ধ ধর্ম অহিংস ধর্ম। যে নারকীয় তাণ্ডব রাখাইনে ঘটছে তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।”

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে শুক্রবার জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখনো অব্যাহত রয়েছে।

এবারের প্রবারণা পূর্ণিমা ছিল ৫ই অক্টোবর। প্রতিবছর এ দিনের ‍শুরুতে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে পূজার মাধ্যমে প্রবারণা পূর্ণিমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা একে একে শীল গ্রহণ, অষ্ট পরিকাসহ মহাসংঘ দান, ভিক্ষু সংঘের পিণ্ডদান গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন।

এদিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডা থেকে ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠানের শেষ হয়। যে আয়োজন এবার বন্ধ রাখে বৌদ্ধ সম্প্রদায়।

কক্সবাজারের রামুতে প্রবারণা উদ্‌যাপন প্রসঙ্গে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বেনারকে বলেন, “আমাদের পাশে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিপীড়িত হলো, আমরা কীভাবে আনন্দ উৎসব করি? তাদের পাশে দাঁড়াতে, সহবেদনা জানাতে ফানুস উত্তোলন করা, কল্প জাহাজ ভাসানোর আয়োজন থেকে বিরত থেকে কেবল কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এবারে প্রবারণা শেষ করেছি।”

তাঁর মতে, “রাখাইনে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা বাহিনী নিপীড়ন চালাচ্ছে। সেখানে ধর্মীয় বিষয়টি আনা মানেই মূল বিষয়টা পেছনে চলে যাবে, বিষয়টা সাম্প্রদায়িক উসকানিতে পরিণত হবে।”

“হতে পারে মিয়ানমার সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর দেশ। তবে সেখানে যা হচ্ছে তা ধর্মের প্রয়োজনে হচ্ছে না। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সামরিক শক্তি বহু বছর ধরে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, যা এ বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ে বহিঃপ্রকাশ পেলো,” বেনারকে বলেন প্রজ্ঞানন্দ।

রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজের এই সহমর্মিতাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ মনে করেন মুসলমানরা।

ইসলামি চিন্তাবিদ মুফতি এনায়েতুল্লাহ বেনারকে বলেন, “বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এই ত্যাগ প্রমাণ করে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।”

চট্টগ্রামে সামান্য কয়েকটি ফানুস উড়ায় কয়েকজন তরুণ-তরুণী। অক্টোবর ০৫, ২০১৭।
চট্টগ্রামে সামান্য কয়েকটি ফানুস উড়ায় কয়েকজন তরুণ-তরুণী। অক্টোবর ০৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো
এদিকে সম্মিলিত বৌদ্ধ সমাজের ঘোষণার পরও প্রবারণার সন্ধ্যায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কিছু কিছু স্থানে ফানুস উড়েছে। তবে তা অন্যান্য বছরের তুলনায় সামান্যই।

চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গণের বিপরীতে ডিসি হিলের ফটক থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কিছু ফানুস ওড়ানো হয়।

এ বিষয়ে বৌদ্ধ সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি অজিত রঞ্জন বড়ুয়া সাংবাদিকদের জানান, “ফানুস না উড়ানোর ঘোষণার সঙ্গে বৌদ্ধ সমাজের সবাই একমত হলেও কিছু কিছু তরুণ উড়িয়েছে। তবে তা অন্যান্য সময়ের চেয়ে সংখ্যায় অনেক কম।”

চট্টগ্রামের যুবক ট্রপেল চাকমা বেনারকে বলেন, “ধর্মীয় রীতির অংশ হিসেবে সামান্য কিছু ফানুস উড়ানো হলেও নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা রয়েছে।”

সুচির বিচার দাবি হেফাজতের

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে দায়ী করে আদালতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের কট্টরপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। মিয়ানমারে হত্যা-নির্যাতন বন্ধের দাবিতে শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামের আয়োজিত সমাবেশ থেকে এই দাবি জানানো হয়।

সংগঠনের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী অং সান সু চিকে ‘আন্তর্জাতিক জঙ্গি ও খুনি’ আখ্যায়িত করে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানান।

তিনি রাখাইনে গণহত্যা বন্ধে কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যথায় মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানান বাবুনগরী।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ডায়রিয়া ও কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা

এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ডায়রিয়া ও কলেরা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। বৃহস্পতিবার জেনেভার জাতিসংঘ দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই আশঙ্কা প্রকাশ করে সংস্থাটি।

ইউনিসেফ জানায়, এ মাসেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর এক বছরের বেশি বয়সী শিশুদের কলেরার টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। মুখে খাওয়ার ৯ লাখ ডোজ কলেরার টিকা শনিবার বাংলাদেশে পৌঁছুবে। ১০ অক্টোবর থেকে শিশুদের এসব টিকা খাওয়ানো হবে।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গার ৬০ শতাংশ শিশু বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। যাদের মধ্যে ৩০ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। গত সপ্তাহ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ৫ হাজার ১১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।